ময়মনসিংহ: কাউন্টার বন্ধ করে পাশের কক্ষে বসে লাভ-ক্ষতির হিসাব করছিলেন সাইফুল ইসলাম (৪০)। তিনি ‘বিশাল মির্জা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস’র ফুলবাড়িয়া-ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটের টিকিট মাস্টার।
অবরোধ-হরতালে নাশকতার ভয়ে মালিকেরা ব্যাংক ঋণে কেনা বাস নিয়মিত চালাতে দিতে সাহস পাচ্ছেন না। আর এতে করে দুর্দশা বাড়ছে সাইফুলের মতো পরিবহন শ্রমিকদের।
শুধু সাইফুল নয়, গাড়ির চাকা না ঘোরায় সাইফুলের মতো আরো অনেক পরিবহন শ্রমিকের জীবনের চাকাও যেন থেমে গেছে। চাল কেনার টাকা না থাকায় চুলাও জ্বলে না বেশিরভাগ সময়।
প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে সাইফুল বলেন, ২০ দিন ধরে চলা অবরোধে এ পরিবহনের আটটি বাসের মধ্যে দু’একটি বাস ফুলবাড়িয়া-ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে আসা যাওয়া করছে। সব বাস না চলায় বেতন পাচ্ছেন না তিনি। ধার-দেনা করে চালাতে হচ্ছে সংসার।
স্বাভাবিক অবস্থায় ফুলবাড়িয়া উপজেলা বাসস্ট্যান্ড থেকে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কে বিশাল মির্জা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস এবং আলম এশিয়া পরিবহন নামে দু’টি বাস সার্ভিসের প্রায় ৬৩টি বাস নিয়মিত চলাচল করে।
আলম এশিয়া পরিবহনের অফিস সহকারী শফিকুল ইসলাম জানান, আগে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫৫টি বাস এখান থেকে ছাড়া হতো। অথচ এখন গড়ে ১০টি বাস চলাচল করছে। অনির্দিষ্টকালের অবরোধে এ পরিবহনের কমপক্ষে তিন শতাধিক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। খরচ বাদে ২০ দিনে মালিকদের লোকসান হয়েছে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা।
পরিবহন শ্রমিকদের কষ্টের দিনলিপি তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব পরিবহন শ্রমিকেরা দিন আনে দিন খায়। গাড়ির চাকা না ঘোরায় পরিবহন শ্রমিকদের আয় বন্ধ। অনেকের হাতেই জমানো কোনো টাকাও নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা।
রোববার (২৫ জানুয়ারি) ময়মনসিংহ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, সারি-সারি বাস দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে কাউন্টার খুললেও ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি যাত্রী হচ্ছে না। হেলপাররা বাসের সামনে দাঁড়িয়ে যাত্রীর জন্য হাঁক দিচ্ছেন। কিন্তু যাত্রী সংকট থাকায় নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা অপেক্ষা করে দেরিতে ছাড়ছে এসব বাস।
কাউন্টারের সামনে রাখা (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪২৯৮০) বাসের চালক মোহাম্মদ সুজন (৩০) জানান, রোববার দুপুর ১২টায় বাসটির ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর যাত্রী মিলেছে মাত্র ১০ জন। সব সিট ভরলে ৮ হাজার টাকা ভাড়া পাওয়া যেতো। এখন জ্বালানি খরচই উঠবে না।
‘সাতদিন বইসা ছিলাম। বাড়িত চাল নাই। বাজার-সদাইও নাই। দু’দিন মালিকের কাছ থেকে চাইয়্যা এক হাজার টাকা নিছি। অহন পকেটে একটাকাও নাই। তাই ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাইতে আইছি। মহাজন অর্ডার দিছে, ঝুঁকি লইয়্যা গাড়ি ঢাকা নিয়া যাইতে। কিন্তু যাত্রী অইতাছে না, কেমনে বেতন উঠবো? সংসারের খরচ চালামু কেমনে? আক্ষেপ করে বলেন এ চালক।
এ টার্মিনালেই পার্কিং করে রাখা বাসের ভেতর বসে অলস গল্প করছিলেন বাস চালক নাজমুল ইসলাম (৩৫)। পাঁচ সদস্যের পরিবারের কর্তা হয়ে অবরোধে কর্মহীন হাতগুটিয়ে বসে আছেন বলে জানালেন তিনি।
রাগে-ক্ষোভে অগ্নিশর্মা হয়ে এ চালক বলেন, বাস চালাইতে না পারায় খাইয়্যা না খাইয়্যা দিন কাটতাছে। গাড়ি না চললে বাড়ির চুলা জ্বলে না। হরতাল-অবরোধকারীরা আমগোর জীবনের চাকাডাই থামাইয়্যা দিছে। নেতারাও সবাই খালি ক্ষমতার লেইগ্যাই কান্দে। আমগোর লেইগ্যা কেউ কান্দে না। হেরা ঘষাঘষি করতাছে আর আমগোর মতো গরিব মরতাছে।
হেলপার শরীফুল বলেন, ড্রাইভাররা তো কোনমতে চলতে পারতাছে। আর আমগোর বাড়িত খাওন নাই। এইলেইগ্যা বাড়িত চুলাও জ্বলতাছে না। এমনে চলতে থাকলে না খাইয়্যা মরতো অইবো।
ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন মালিক সমিতির কোচ বিভাগের সাধারণ সম্পাদক বিকাশ সরকার বলেন, অবরোধে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম রুটে অল্প কিছু দূরপাল্লার যান চলাচল করছে। যেসব দুরপাল্লার যান চলাচল করছে না, তার শ্রমিকদের অসহায় কষ্টে কাটছে জীবন।
বাংলাদেশ সময়: ২৩০৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৫