ঢাকা: প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ের ১টি পদে নিয়োগের জন্য ৬ মন্ত্রী, ২ প্রতিমন্ত্রী, ১ জন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতা চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির ধানমণ্ডির কার্যালয়ে ‘মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর রাজনৈতিক এ তদবিরের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিএজি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া স্বত্বেও এখানে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। চলমান একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি মাঝারি পদের জন্য ৬ জন মন্ত্রী চাপ দিয়েছেন।
চাপ প্রয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে সংবাদ সম্মেলনে ইফতেখারুজ্জামন বলেন, আবেদনকারীর দরখাস্তে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং এমপির লিখিত সুপারিশ ছিল। এরপর তার নিয়োগের জন্য ফোন করেও চাপ দেওয়া হয়।
তবে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি। এজন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যের নাম সংবাদ সম্মেলনে জানা যায়নি।
তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এমন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি টিআইবির।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএজি কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক তদবির রয়েছে। নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক এবং এমএলএসএস নিয়োগেও মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তদবির করে থাকেন।
এতে বলা হয়, ২০১৪ সালে সিজিডিএফ’র বিভিন্ন পদে মোট ৪১৩ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। যাতে বড় অংকের অর্থের লেনদেন হয়েছে। নিরীক্ষক ও অধস্তন নিরীক্ষককে নিয়োগ পেতে বড় অংকের লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে সিএজির নিয়ন্ত্রণাধীন অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (ফিন্যান্স) রেলওয়েতে প্রায় ৫০০ জন নিরীক্ষক ও অধস্তন নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এসময় প্রায় অর্ধেককেই প্রতিটি পদের জন্য ৩-৪ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ধরণের দুর্নীতির সঙ্গে সিএজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে নিরীক্ষা আইন না থাকা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি আইনগুলো হাল নাগাদ না করা, মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রয়োজনীয় জনবল, সুযোগ সুবিধা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরিবীক্ষণে সমস্যা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জবাব না দেওয়া ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়া এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসি) কর্তৃক সব প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা না করাসহ মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে বিরাজমান সুশাসনের ঘাটতিজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগ প্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র প্রতিবেদনে উঠে আসে। সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিটের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে, যার পরিমাণ কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘুষের পরিমাণ নির্ভর করে অডিট ইউনিটের বাজেটের পরিমাণের ওপর।
এছাড়া তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা, অতিরিক্ত অর্থ আয়ের সুযোগ সম্পন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠা যেমন-বন্ডেড ওয়্যার হাউজ, ডিফেন্স অডিটের পূর্ত সংক্রান্ত, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল নিরীক্ষা করার জন্য ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি।
প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন-সিএজি কর্তৃক বার্ষিক পরিকল্পনা না করা, মহাপরিচালক পর্যায়ে জবাবদিহিতা না থাকা, উপ-পরিচালক পর্যায়ে মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা আপত্তি যাচাই-বাছাই না করা, কখনও কখনও অন্যায়ভাবে আপত্তি নিষ্পত্তি করা, মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষার কাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক পরিবীক্ষণ না করা, মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষাকালীন দুর্নীতি ধরা পড়লেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও তারিখ এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি ঠিক নেই বলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিরাজমান। আমাদের সংবিধান, শাসন কোনো না কোনোভাবে এক কেন্দ্রিকতার মধ্যে থাকছে। নিরীক্ষণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে তদবিরের সংস্কৃতি মহামারীর মতো হয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি না করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মহা হিসাব-নিরীক্ষকের আওতায় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা থাকলেও প্রায়োগিক কাজে সেটি ব্যাহত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র দেখা যায়। ৬ বছর ধরে নিরীক্ষা আইন খসড়া হয়ে আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা অনুমোদিত হচ্ছে না। যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ কামনা করছি।
মহা হিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ের সুশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে, তা থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে।
স্বল্পমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অনিয়ম দুর্নীতি রোধকল্পে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্গানোগ্রাম ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেওয়া, সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সব বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন -রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়। সুলতানা কামাল ও ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিহ ছিলেন টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
** সিএজিতে পদে পদে দুর্নীতি, মন্ত্রী-এমপির তদবির
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৫