ফরিদপুর: সেদিনের পেট্রোল বোমায় আমার প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে পুড়ে গেছে আমার জীবনের সব স্বপ্ন। নিজেকে নিয়ে আর কোনো স্বপ্ন দেখি না।
বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পেট্রোল বোমায় নিহত ফরিদপুরের ট্রাকচালক মেহেদী হাসানের স্ত্রী কোহিনূর বেগম এভাবেই অশ্রুসজল নয়নে বলছিলেন তার সংসারের স্বপ্নভঙ্গের কথা।
নিহত ট্রাকচালক মেহেদী হাসান (২৮) ফরিদপুর শহরতলীর বায়তুল আমান এলাকার তারা মিয়ার ছেলে। পদ্মা নদীর ভাঙনে ভিটে-মাটিহারা তারা মিয়ার বড় ছেলে মেহেদী হাসান ট্রাক চালিয়ে সংসার চালাতেন। বিএনপির ডাকা অবরোধের সময় ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক চালাতে বের হয়েছেন মেহেদী হাসান।
২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে ট্রাক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে শহরের টেপাখোলা এলাকায় তার ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছোড়ে অবরোধ সমর্থকরা। এতে গুরুতর আহত হন মেহেদী হাসান। ওই রাতে তাকে প্রথমে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ ডিসেম্বর সকালে মারা যান মেহেদী হাসান।
মেহেদীর স্ত্রী কোহিনূর বলেন, শশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর ও তার স্ত্রী-সন্তান আর নিজের দুই সন্তানসহ নয় সদস্যের পরিবার তার। এদের মধ্যে একমাত্র উপাজর্নক্ষম মেজ দেবর মন্টু শেখ। গাড়ি চালিয়ে তিনি যা আয় করেন তা দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধের পর কোনো রকমে সংসার চলে। এ অবস্থায় ঠিকমতো ভাতই জোটে না, সেখানে কিভাবে মেয়ের লেখাপড়া চালাই?
কোহিনূর বলেন, প্রতিবেশীদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে যেতে দেখে বড় মেয়ে মিথিলা (৫) বায়না ধরেছে, স্কুলে যাবে। কিন্তু অর্থের অভাবে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে পারছি না। বাড়ির আশেপাশে কোনো সরকারি স্কুল না থাকায় আরো সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এখন স্কুলে ভর্তি আর তার পোশাক বানাতে যে টাকা লাগবে, তা যোগাড় করতে পারি নাই।
মেয়ের কান্না থামাতে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে মাঝে মধ্যে নিয়ে যাই ওকে। তবে সবকিছু বুঝে ফেলে মিথিলা। সে প্রশ্ন করে, ওর স্কুলের ড্রেস বানাই না কেন? আমি জবাব দিতে পারি না।
এখানেই শেষ নয়। অবুঝ মিথিলা ও ছোট মেয়ে মিম (৩) এখনো বিশ্বাস করে, তাদের বাবা মেহেদী হাসপাতালে আছেন। অন্য কোনো বাবাকে তাদের মেয়েকে আদর করতে দেখলে তাদের বাবাকে কেন হাসপাতাল থেকে বাড়ি আনা হয় না তা নিয়েও কান্নাকাটি করে।
কোহিনূর বলেন, মেয়ে দু’টো দোকান থেকে কিছু খাইতে চাইলেও অর্থের অভাবে তা কিনে দিতে পারি না। মেয়েদের কান্না থামাই ধমক দিয়ে। এসব কিছুর জন্য দায়ী হরতাল অবরোধকারীরা।
তার কথা, স্বামী থাকতে সবই তিনি করতেন। কারো দিকে তাকাতে হতো না। তার মৃত্যুর পর এখন আর পরিবারের খবর কেউ রাখে না।
দুই সন্তানের ভবিষ্যত ভেবে তাই আকুল মা কোহিনূর বেগম। মেহেদী হাসানের করুণ মৃত্যুর পর জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর তেমন কেউ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেননি। যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোহিনূর বেগমকে কোনো একটা চাকরি দেবেন, তারাও আর খোঁজ নেননি। এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে এখন দিন কাটে তাদের।
পেট্রোল বোমা মেরে হত্যার ঘটনায় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় নিহত মেহেদীর পিতা তারা মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। সেই মামলার আসামিরা পরে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান।
নিহত মেহেদী হাসানের স্ত্রী কোহিনূর বেগম আরো জানান, মেহেদী মারা যাওয়ার পর আমাকে অনেকেই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমন কি আমার একটা চাকরির প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখন আর কেউ আমাদের খোঁজ নেননি।
কোহিনূর বেগম বলেন, সম্বল শুধু জনতা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের দুই মেয়ের জন্য মেয়াদী আমানতের টাকা। সংসার চালাতে প্রতিদিন টাকার দরকার হয়। কিন্তু মানুষের কাছে হাত পেতে আর কতোদিন চলা যায়? আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য আমার একটি চাকুরি দরকার।
কেউ কি আমাকে একটি চাকরি দিতে পারেন না? কেউ কি নিতে পারে না আমার সন্তানের লেখাপড়ার ভার?- আকুতি ঝরে পড়ে কোহিনুরের কণ্ঠে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৫