ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সীমান্তে উত্তেজনা কী ইঙ্গিত দেয়?

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
সীমান্তে উত্তেজনা কী ইঙ্গিত দেয়? শিবগঞ্জ সীমান্তে সতর্কাবস্থানে বিজিবির সদস্যরা। ফাইল ছবি

ঢাকা: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট জনরোষের মুখে পলায়নের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়াসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে।

‘আস্থাভাজন’ শেখ হাসিনার সরকারের আকস্মিক পতনের পর সৃষ্ট ঘটনাপ্রবাহে প্রথমে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় নয়াদিল্লির সরকার। এরপর নামমাত্র চিকিৎসা ও জরুরি ভিসা চালু রাখে। এর মধ্যে সনাতনীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের গণমাধ্যমে সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা, এর জেরে আগরতলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ভারতের উগ্রবাদীদের হামলাসহ নানা ইস্যুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক ৫৩ বছরের মধ্যে একেবারে তলানিতে ঠেকে যায়।

যদিও দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং গত এক মাসের বিভিন্ন আলোচনায় মনে হয়েছে, খানিকটা সহজ হয়ে আসছে সম্পর্ক।

কিন্তু সবশেষ নতুন করে টানাপোড়েন উসকে দেয় সীমান্ত ইস্যু। সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার সীমান্তে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তোলার পর সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে বাধা দেওয়া হয়। আর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে কয়েক দফায় বেড়া স্থাপনের চেষ্টা চালায় বিএসএফ। তবে বিজিবি সদস্যদের বাধার মুখে তা আর পারেনি।

হঠাৎ কেন সীমান্তে বিএসএফ এমন তৎপর হলো, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তাদের এ কার্যকলাপের ইঙ্গিতইবা কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন বিশ্লেষকরা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ‘নতুন চিন্তার’ প্রকাশ ঘটছে সীমান্তে। তারা বাংলাদেশের সীমানায় নজরদারি আরও শক্তিশালী করার জন্য সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে, নাইট ভিশন ক্যামেরা ও মুভমেন্ট ডিটেক্টর যা নিরাপত্তার দিক থেকে বিএসএফের কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার।

তথ্য মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার স্থানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেছে এবং ৮৮৫ কিলোমিটার স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়নি। সেসব স্থানেই ভারতের বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া বানাতে চাইছে।

সীমান্ত ইস্যুতে উত্তেজনার মধ্যেই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। রোববার বিকেলে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন তিনি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে।

গত সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা চলে। ৮ জানুয়ারি চৌকা সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

সীমান্তের এক হাজার ২০০ গজের মতো অংশে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল বলে জানান ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া। বিজিবি থেকে এ নিয়ে বাধা দেওয়া হয় এবং সাময়িকভাবে কাজ থামানো হয়।

নিয়ম অনুযায়ী সীমান্ত লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয় যেটা এক্ষেত্রে ভারতের বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেড়া দেওয়া স্থগিত করা ইস্যুতে বিএসএফ ১০ জানুয়ারি বলে যে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অরক্ষিত অংশগুলোতে বেড়া দেওয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এড়াতে।

বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু বেড়া দেওয়ার কাজটি জরুরি নয়, তাই আমরা এটি কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রেখেছি, যাতে অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা, সংঘাত বা বিভ্রান্তি এড়ানো যায়। কাজ শিগগিরই শুরু হবে, তবে আমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দিচ্ছি না।

নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার বস্তাবর সীমান্তের ওপারে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে বাধা দেয় বিজিবি। পরে কাজ না করেই ফিরে যান বিএসএফের সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক ডাকা হয়।

বিজিবির নওগাঁ-১৪ পত্মীতলা ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, ওই সীমান্তে প্রায় ৬০০ গজের মধ্যে দুই দেশের কোনো বেড়া নেই। গত বুধবার বিজিবির সঙ্গে কোনো সমঝোতা ছাড়াই সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ভারতীয় সীমান্তে বিএসএফের সদস্য ও কিছু নির্মাণশ্রমিকের কার্যক্রম চোখে পড়ে। জানতে পেরে বিজিবি সদস্যরা তাদের বাধা দেন। পরে কাজ না করেই ফিরে যান বিএসএফের সদস্যরা।

তিনি জানান, আইন অনুযায়ী সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে ফসল চাষ ছাড়া সীমান্তবর্তী কোনো দেশ তাদের সীমানায় বেড়া কিংবা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু বিএসএফের সদস্যরা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে সীমান্তে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করেন।
 
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম সীমান্তের শূন্যরেখায় কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করার চেষ্টা করেছে ভারত। খবর পেয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে বেড়া নির্মাণের প্রতিবাদ জানায়। এমন পরিস্থিতিতে ওই এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়।  

রংপুর ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের সহকারী পরিচালক (এডি) আমীর খসরু জানান, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিএসএফকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে কাজ বন্ধ করে পরে আবার শুরু করে। বিজিবি-বিএসএফের সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বিএসএফকে বেড়া সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।

বিএসএফ ২০১০ সালে দহগ্রামের প্রবেশদ্বার তিনবিঘা করিডোর সংক্রান্ত চুক্তির তথ্য উপস্থাপন করে সীমান্তের শূন্যরেখায় একসারি কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের যুক্তি তুলে ধরে। কিন্তু বিএসএফই ২০২১ সালে ওই চুক্তি অমান্য করে। তখন তিনবিঘা করিডোর দিয়ে দহগ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ অপটিক্যাল ক্যাবল লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করলে তাতে বাধা দেয় বিএসএফ। সেই ঘটনার এখনো কোনো সমাধান হয়নি।

কোনো আলোচনা ছাড়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ বা চেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিএসএফের এমন কর্মকাণ্ডের পেছনে কারণ খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।  

বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে ফেলানীসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিএসএফের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এবং সীমান্তে নতুন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে।

একাধিক কূটনীতি বিশ্লেষক বলেন, সীমান্ত সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। সীমান্ত নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা মোটেও সমীচীন নয়। তাহলে উভয়পক্ষেরই ক্ষতি হবে।

এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রোববার এক ব্রিফিংয়ে বলেন, বিগত সরকারের সময়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়া নিয়ে যেসব অসম সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, সেগুলো বাতিলের বিষয়ে পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী মাসে (ফেব্রুয়ারিতে) বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ডিজি পর্যায়ে বৈঠক হবে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সীমানা নির্ধারণ ও উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব পালন–সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের মধ্যে সই হওয়া মোট চারটি চুক্তি আছে বলেও জানান উপদেষ্টা।  

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম সীমান্ত নির্দেশাবলি-১৯৭৫ অনুযায়ী উভয় দেশের শূন্যরেখা ১৫০ গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা সামর্থ্যতা–সংবলিত যেকোনো কাজ সম্পন্নের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া উভয় দেশের প্রয়োজনে শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজ সম্পন্নের ক্ষেত্রে একে অন্যের সম্মতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বিজিবির সঙ্গে যূথবদ্ধ হয়ে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার প্রতিবাদ করা উপদেষ্টা সীমান্তবর্তী জেলার অধিবাসীদের ধন্যবাদ জানান। বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বিএসএফের সঙ্গে বিজিবির যোগাযোগ হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও এ বিষয়ে এরইমধ্যে জানানো হয়েছে।

আর তলবে এসে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়ে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, নিরাপত্তার জন্য সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। এ নিয়ে বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়ার বাস্তবায়ন হবে।

সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ রোববার রাতে বাংলানিউজকে বলেন, সীমান্ত  ব্যবস্থা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের চারটি চুক্তি রয়েছে। সেগুলো উভয়পক্ষের মেনে চলতে হবে। সীমান্তে ১৫০ গজের মধ্যে কোনো দেশেরই স্থাপনা থাকতে পারবে না, এটিই নিয়ম। তবে সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা প্রয়োজন। সীমান্ত নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা মোটেও সমীচীন নয়। তাহলে উভয়পক্ষেরই ক্ষতি হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০২৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।