ঢাকা, সোমবার, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

পথের শিশু

গোবরে ফোটে না পদ্মফুল!

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৫
গোবরে ফোটে না পদ্মফুল! ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: কাটা ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে দেড় বা ২ বছরের মাসুমের। পিঠের ওপর বড় ভাইয়ের লাফানোর অত্যাচার সহ্য করছিল কাঁদতে কাঁদতে।

সাড়ে ৩ বা ৪ বছরের মামুনের ভাষায়, ছোটো ভাই পাগল হয়ে গেছে। না হলে তার সঙ্গে ভিক্ষা করছে না কেন! নিজের নোংরা হাফপ্যান্টটা ওপরের দিকে দুই হাতে টেনে ওঠায় সে।

গত ডিসেম্বরে প্রাথমিক সমাপনীর ফলের দিন ধানমন্ডি গভ. বয়েজ স্কুলের সামনের ওভারব্রিজের নিচের ঘটনা এটি। শত শত মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। চোখে পড়লেও ভ্রক্ষেপ নেই কারোই। মাসুমের পিঠের ওপর লাফাচ্ছে মামুন। পিচের ফুটপাথে ধুলামাখা শরীরের বিভিন্ন জায়গা কেটে যাচ্ছে। চোখের নোনা জল বালুমাখা গালে চুইয়ে পড়ছে। মামুনের চোখে রাজ্যের ক্রোধ তখন, ছোটো আদরে ভরা চোখ দুটো থেকে ছোটো ভাইটার প্রতি ঘৃণা উপচে বেড়োচ্ছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ও কে? বললো, আমার ছোড ভাই। লাফাচ্ছো কেনো, জানতে চাইলাম। মামুনের উত্তর, ও পাগল হইয়া গেছে, ভূতে ধরছে। ওরে আইসক্রিম খাওয়াইতে কয়।

ছোট ভাইকে টেনে রাস্তায় নামাতে চাচ্ছে মামুন। গাড়ি থেকে গাড়ির জানালায় ঘুরে দুই ভাইয়ে মিলে হাত বাড়ানোর কথা। দেড় বছরের মাসুম সঙ্গে থাকলে আয় হয়তো বাড়ে, সেটা জানে বড় ভাই।

মা কই জানতে চাইলাম। মামুন বললো, মায়ের জ্বর, বাসায়। ছোটো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে, ‘ওয় রাস্তায় না নামলে ট্যাকা পামু কেমনে! ওরে ভূতে ধরছে। আইসক্রিম না খাওয়াইলে নাকি ও রাস্তায় নামবো না!’ এই বলে আবারো ছোটো ভাইয়ের গায়ে হাত তোলা শুরু করলো।

অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে মাসুম। স্কুলের সামনে বসা কয়েকজন অভিভাবকের চোখেও এ নারকীয় অত্যাচার চোখে পড়লো। কয়েকজন মিলিয়ে ২শ’ টাকা উঠিয়ে সে যাত্রায় শিশুটিকে রক্ষা করা হলো।

এ সন্তানদের পিতার কথা তারা জানাতে পারেনি। বলেছিল, মা তাদের নিয়ে রাস্তায় বের হন। কিন্তু কয়েকদিন ধরে জ্বরে বের হতে পারছেন না। দুই সন্তানকে পাঠিয়েছেন এখানে। বাসার ঠিকানা বলতে পারে না, তবে হেঁটে গেলে বাসা চিনতে পারবে তারা।

ছোট ভাইকে হাত ধরে হেটে রাস্তা পার হতে চায় মামুন। কিন্তু মাসুম আইসক্রিম ছাড়া শোয়া থেকে উঠবে না। এবার কোলে করে হেঁচড়ে ছোট ভাইকে টেনে নেয় সে। আরেক হাতের কনুই দিয়ে সর্দিঝরা নাকটা মুছে নেয়।

আমরা সকলেই পা বাড়াই নিজেদের গন্তব্যের দিকে। এই পথশিশুদের পক্ষে পদ্মফুল হয়ে ওঠা কি সম্ভব!

আর্থিকভাবে অস্বচ্ছলের একটা সীমা থাকে। এ দারিদ্র্য সীমাকেও অতিক্রম করেছে। এই গোবর থেকে পদ্মফুল বের হওয়া অনেক বেশি দুরুহ। যেখানে, গভ. বয়েজ স্কুলে ধবধবে সাদা শার্ট পরা শিশুটিকে হাত ধরে স্কুলের গেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন মা। স্কুলের ঘণ্টার সঙ্গেই মায়ের হাতে চলে আসে স্কুল ব্যাগ। মা-ছেলে উঠে যায় গাড়িতে। এই বাগানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোবরের পদ্মফুলের অপেক্ষা দূরাশাই।

৮ থেকে ১০ বছর বয়সী পথশিশুদের যখন পলিথিনে মোড়ানো সল্যুশন নামক নেশা টানতে টানতে পার্কের বেঞ্চে ঝিমিয়ে পড়ে যেতে দেখা যায়, তখন মাসুম-মামুনদের এর সঙ্গে মেলানো খুব কঠিন হয় না।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ ধরনের নেশা করা শিশু রাহুল জানায়, পথেই তার ঘর-বাড়ি। মা নেই, বাবা থেকেও নেই। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর সৎ মায়ের অত্যাচারে ঘর ছাড়ে সে। এখন রাত হলে এ পার্কের বিভিন্ন ইটের স্তম্ভের কোনো একটিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

রাত ১০টার দিকে নীলক্ষেত। দড়ি দিয়ে বাধা বোতলভর্তি ভ্যানচালকের চোখ সামনের দিকে। জিভের ভেতর থেকে ধারালো ব্লেড বের হয়ে আসে ১১-১২ বছর বয়স এক শিশুর। ব্লেড দিয়ে ভ্যানের পেছন থেকে দড়ি কেটে প্লাস্টিকের খালি বোতল ছিনিয়ে ভো-দৌড়। চোখে চোখ পড়তেই, যে আনন্দের ঝিলিক শিশুর চোখে দেখা গেলো, নতুন জুতো কিনলে অভিজাত শপিং মলে শিশুদের চোখে এ আনন্দ দেখা যায়।

এভাবেই অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে পথশিশুরা। সেই অপরাধের ভেতর থেকে ফুল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা এ জামানায় ভাবা বেশ দুরুহ।

আর্ন্তজাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) এবং মোস্ট অ্যাট রিস্ক অ্যাডেলেসেন্ট (এমএআরএ) এর এক জরিপে দেখা যায়, দেশে পথশিশুদের সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। তবে আরো বিভিন্ন বেসরকারি তথ্য মতে এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়াবে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যর মতো মৌলিক অধিকারের সবগুলো থেকেই বঞ্চিত এসব শিশুরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সফিউল ইসলাম কাজ করছেন পথশিশুদের নিয়ে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন,  অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পথশিশরা পিতৃ কিংবা মাতৃহীন, মা তালাকপ্রাপ্ত কিংবা বাবা মারাত্মক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। আবার এদের অভিভাবকদের অনেকেই মাদকাসক্ত। নিজের ভরণ-পোষণের দ্বায়িত্ব নিজেই নিয়েছে এসব শিশুরা। আবার অনেক সময়, পথের মায়েরাই সন্তান জন্ম দিচ্ছেন পথ থেকে আয় বৃদ্ধির জন্যে।

তিনি বলেন, পথশিশুরা অনিরাপদ জীবন কাটায়। যেখানে তারা অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আবার অনেকেই নিজেরাই যৌন নির্যাতন করছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিশুদের। এছাড়াও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের মাদক, অস্ত্র এবং অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

এসব শিশুদের পুর্নবাসনে সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি উদ্যোগ রয়েছে। তবে রাস্তায় গাড়ির জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া শিশু সংখ্যা কমে না। এসব শিশুদের গোবর থেকে পদ্মফুল হয়ে ওঠার গল্পও শোনা যায় না।

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।