ঢাকা: সারা দুনিয়ার দুঃখ-যন্ত্রণা তার মাথার ওপর ভর করে আছে। কিন্তু তবুও সারাক্ষণ আল-আমিনের (৮) ঠোঁটে হাসির রেশটা লেগেই থাকে।
কিন্তু না! এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। আট বছর বয়সী শিশু আল-আমিন জন্ম থেকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। দুনিয়ার সব সব দুঃখ-যন্ত্রণা তার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির কাছে একেবারেই তুচ্ছ।
রাজধানীর পরিবাগের রাস্তার পাশে ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে আল-আমিনের পরিবার। মা ছাড়া আর কেউ নেই তার। ঘর বলতে কিছুই নেই তাদের। সংসারে আছে শুধু একটি চকি (খাট), দু’টি বালিশ, আর ভাঙ্গা পরিত্যক্ত একটি ছোট আলমারি। আর ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে পলিথিন।
বছরের পর বছর পথশিশু দিবস পার হয়ে যায়, কিন্তু দুঃখ যন্ত্রণা কাটে না আল-আমিনের পরিবারের।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধি এই শিশুর জীবনকে শিক্ষার আলোতে গড়ে তোলার স্বপ্ন মনে লালন করছেন তার মা।
‘মনে অনেক আশা, পোলা বড় হইবো, লেখাপড়া হিগ্গা (শিখে) মানুষের মতো মানুষ হইবো’ -আশাময় চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন পথশিশু অল-আমিনের মা তাসলিমা বেগম।
আল-আমিনের বাবার নাম দুলাল মিয়া। তিনি ছিলেন একজন রিকশাচালক। কিন্তু না বলা কোনো এক কারণে পরিবারকে ফেলে চলে যান তিনি। সংসার চালানোর মতো কোনো সামর্থ্য নেই তাসলিমার। কারণ, তিনিও একজন প্রতিবন্ধি। জন্মের পর থেকে হাঁটা-চলা করতে পারে না তিনি।
তাসলিমার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরের সিরাজদিখাঁন থানায়।
তিনি বলেন, মা মারা যাওনের পরে ভাই আমারে একলা হালাইয়া (ফেলে) গেছে গা। কারণ, আমি প্রতিবন্ধি। কাজ করতে পারতাম না। পরে আমি ঢাকা আহি (আসি)। পেরায় (প্রায়) ৬ বছর হয় আমি এই রাস্তায় থাকি।
‘আমগো সংসার চালাইতে অনেক কষ্ট হয়। মাইনসের (মানুষের) থিক্যা সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে চলি’ -বললেন তাসলিমা।
‘আল-আমিন কিছু মনে রাখতে পারে না। মাতায় (মাথা) সমস্যা, প্রতিবন্ধিতো তাই। ওর চিকিৎসা করাইয়া একটা প্রতিবন্ধি স্কুলে ভর্তি করমু। কারণ, রাস্তায় থাকলে পোলাডারে মানুষ করতে পারমু না। ’
পথশিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে রয়েছে স্কুল। ছিন্নমুল পথশিশুরা সেখানে বিনামূল্যে পড়াশোনা করে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর পরিবাগেও রয়েছে পথশিশুদের এমন একটি স্কুল। প্রথম সূর্য স্কুল। আল-আমিন সেই স্কুলে পড়তে যায় প্রতিদিন।
‘এই পাড়া-মহল্লার মাইনসে আল-আমিনরে অনেক আদর করে। স্কুলের স্যার-ম্যাডামরা আদর করে’ -বললেন তাসলিমা বেগম।
প্রথম সূর্য ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পশশিশুদের জন্য এই স্কুলটি চালু করা হয়। বিনামূল্যে পথশিশুদের শিক্ষার সুবিধা দিতেই ২০১০ সালের এপ্রিলে স্কুলটি
প্রতিষ্ঠিত হয়। দেড় শতাধিক পথশিশু প্রতিদিন এই স্কুলে পড়াশোনা করতে আসে বলে জানান স্কুলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক মো. আব্বাস ভূঁইয়া। তিনি বারডেম’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
তিনি বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো পথশিশু যাতে নিরক্ষর না থাকে। শিক্ষার আলো থেকে যেন তারা কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয়।
পথশিশুদের পড়াশোনার সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব আমরা নিয়ে থাকি। প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এখানে তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আমরা শিশুদের মৌলিক কিছু জ্ঞান দেই। যেমন, প্রতিদিন সকালে ও বিকালে খাওয়ার পরে দাঁত ভালো করে ব্রাশ করা, খাওয়ার আগে ও পরে হাত সাবান দিয়ে ধোয়া ইত্যাদি।
মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পথশিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন এখানে।
তিনি বলেন, এই স্কুলে শিশুরা নিজেরাই তাদের বসার জন্য বিছানা বিছিয়ে নেয়। এটা করার কারণ যাতে নিজেরাই নিজেদের কাজ করতে পারে।
পশশিশুদের জন্য অনেকেই এ স্কুলে অনুদান দেন। তবে এগুলো হলো বাচ্চাদের জন্য বই, খাতা, খাবার, কাপড়, স্কুলের ব্যাগ ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০১৫
** গোবরে ফোটে না পদ্মফুল!
** ‘বড় মিষ্টি খামু’