ঢাকা: আবার ফিরে এসেছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আনন্দ-বেদনা ও সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক মাস এটি।
সেই অধিকারকে সম্মান দেখিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। বর্তমানে বিশ্বের ১৮৮ দেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়।
যা পৃথিবীর ২৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য অপরিমেয় এক আনন্দের বিষয়। সেই আনন্দের উল্টো পিঠের চিত্রটাও কিন্তু ভয়ঙ্কর।
আজকাল অনেক চাকরির পরীক্ষাতেই বাংলাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় কারা হয়েছে। সরকারি নোটিশ, বিজ্ঞাপন ও প্রজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার শব্দ ইংরেজি হরফে লেখা হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের নাম, গণমাধ্যমের নাম, সাইনবোর্ড, ব্যানার ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে-সেসব না হয় বাদই দিলাম।
ইংরেজি ভাষার প্রয়োজন আছে, তার মানে এই নয় যে, মাতৃভাষা উপেক্ষা করে সেই প্রয়োজনটা দেখাতে হবে। চীন-জাপান- কিউবাসহ অনেক দেশ ইংরেজিকে থোরাই কেয়ার করে দিব্যি তাদের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রেখেছে। তাহলে আমাদের কেন মাতৃভাষার প্রতি এতোটা অবহেলা ?
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘আগে চাই মাতৃভাষার গাঁথুনি, তারপর বিদেশি ভাষার পত্তন। ’ মাতৃভাষাটা ভালোভাবে শিখেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত বহুভাষাবিদ পণ্ডিত হয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন।
এই প্রতিযোগিতার বাজারে ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। এই কথাটি যেমন সত্য, তেমনি মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে নিস্তার থাকলেও বিবেকের দংশন থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
‘আমার ছেলে বাংলা বোঝে না। ইংরেজিতে ভালো এক্সপার্ট ’ বলে যে অভিভাবকরা লোক মহলে গর্ব অনুভব করেন। বস্তুত তাদের গর্ব নয়, হীনমন্মতাই প্রকাশ পায়।
যাহোক, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা একটু বেশি মাত্রায় বাঙালিয়ানা শুরু করি। ষোলআনা বাঙালি সাজতে প্রাণন্তর চেষ্টা করি। আমাদের অন্তরে যতটা না বাঙালি চেতনা ও অস্তিত্ব বোধ আছে তার চেয়েও বেশি মাত্রায় কিছু করার চেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকে।
ভাষার এই মাসের প্রতি ফ্যাশনেবল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে ‘অ, আ, ক, খ, ঙ,’ খচিত পোশাক পরিধান করি। মোবাইলে ভাষা বিষয়ক ওয়েলকাম টিউন ও রিংটোন লাগাই। সুযোগ পেলে বক্তৃতা-সেমিনার করে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করি। আর যুগ-যুগ ধরে নিজেরাই বাংলা বানান, উচ্চারণ, শব্দ চয়ন, প্রক্ষেপণ ও প্রয়োগ ভুল করি।
অফিসিয়াল কাজেও আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্ত না হতে পেরে আমরা মাঝে মাঝে লজ্জায় পড়ি। কিংবা গোটা অফিসে বিভিন্ন অঞ্চলের মিশ্র উদ্ভট এক ভাষার কারখানা তৈরি করে ফেলি।
এই অঞ্চলিক ভাষাটাই আবার নিজের গ্রামে, নিজের ভিটায় মহাঅলঙ্কার ও অহংকার হিসেবে বিবেচিত হয়। সেটা ভিন্ন বিষয়।
বিচিত্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েও আমরা এই মাতৃভাষার খোঁজ-খবর নেই না, একটু দরদ দিয়ে পরিচর্যা করি না, একটু শেখার, জানার ও বোঝার চেষ্টা করি না। বরং ইংরেজি, হিন্দি ভাষার সংমিশ্রণে উদ্ভুত এক বিকৃত ভাষা সৃষ্টি করে দুঃখিনী এই মাতৃভাষাটার উপর নির্যাতন চালাই। সেই নির্যাতনের সিংহভাগ অংশীদার দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি এফএম রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ।
বাংলা ভাষা দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ ও প্রয়োগের দায়ভার শুধু নিরীহ আরজে (রেডিও জোকি) বা উপস্থাপকদের দিয়ে লাভ নেই। কারণ যারা এই সব চ্যানেলের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস আমাদের নেই।
আবার এটাও সত্য ওই সব রেডিও ও টিভি চ্যানেলের কিছু কিছু অনুষ্ঠানের মান, আরজে ও উপস্থাপকের নন্দনিক পরিবেশনা প্রশংসারও দাবি রাখে।
যখন কোনো রেডিও বা টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক বা প্রতিবেদকের ভুল উচ্চারণে ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ শুনতে হয় তখন নিরবে ব্যথিত হওয়া ছাড়া কি বা করার থাকে আমাদের?
বিশেষ করে টিভিতে বেশির ভাগ জেলা প্রতিনিধিদের লাইভ সংবাদ পরিবেশন বা প্রতিবেদন কানে আসলে মেজাজ খিটখিটে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অথবা নিউজরুম থেকে সংবাদ উপস্থাপক ইংরেজি বাক্যের ফরমেটকে ভিত্তি করে বাংলা বাক্যের অপপ্রয়োগে তথাকথিত স্মার্টনেস দেখিয়ে রিপোর্টারকে উদ্দেশ্য করে যখন বলেন, ‘সাজ্জাদ আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?’ তখন নিশ্চয়ই ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মা আর্তনাদ করে উঠে শুদ্ধ সেই বাক্যটি শোনার জন্য- ‘সাজ্জাদ আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ?’
এদিকে তেজপাতার মত গজিয়ে উঠা অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভুলে ভরা কুরুচিপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন নিশ্চয়ই রুচিশীল মানুষকে আহত করে।
প্রিন্ট কিংবা অনলাইন গণমাধ্যমেও বাংলা ভাষা শব্দের বানান ও ব্যবহার নিয়েও রয়েছে ব্যাপক জটিলতা। কোনো কোনো গণমাধ্যম বানান রীতির ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির রীতিনীতি অনুসরণ করে। আবার কেউ কেউ কলকাতার সংমিশ্রণে নিজস্ব বানান রীতিও ব্যবহার করে থাকে।
ফলে বাংলা একাডেমির রীতি এবং অন্য কোনো রীতি-পদ্ধতির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রাট দেখা দেয়। যার কোনো সুনিদির্ষ্ট সমাধান আমাদের কাছে দুর্বোধ্যই থেকে যায়। সর্বজন গৃহীত নির্দিষ্ট বানান, উচ্চারণ ও প্রয়োগ রীতির মানদণ্ড সবাইকে মানতে বাধ্য করতে পারেনি বাংলা একাডেমি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বিভ্রান্তিকর।
তেমনই কিছু বিভ্রান্তিকর বানান নিম্নে উপস্থাপিত হলো
মেডিকেল-মেডিক্যাল, শ্রেণি-শ্রেণী, কর্পোরেশন-করপোরেশন, চেয়ারপার্সন-চেয়ারপারসন, মাদ্রাসা-মাদ্দ্রাসা, সামিয়ানা-শামিয়ানা, সীম-শিম, নাস্তা-নাশতা, রিক্সা-রিকশা, করব-করবো, বলব-বলবো, হব-হবো, হল-হলো, উঠে-ওঠে, কখনও-কখনো, আবারও-আবারো, আরও-আরো, তারও-তারো, দেওয়া-দেয়া, লিখব-লিখবো, বাংলা-বাঙলা, বাঙালি-বাঙ্গালি, ভাঙা-ভাঙ্গা, লাঙল-লাঙ্গল, রঙ-রং, কালো-কাল, ভালো-ভাল, ভালোবাসা-ভালবাসা, হতো-হত, মতো-মত,বারো-বার, জানাযা-জানাজা, জাকাত-যাকাত, ডিসপেন্সারি-ডিসপেনসারি, ম্যাঞ্চেস্টার- ম্যান্চেস্টার, লন্ডন-লনডন, ইউনিভার্সিটি-ইউনিভারসিটি, অ্যাডভোকেট-এ্যাডভোকেট, অ্যাটর্নি-এ্যাটর্নি, অ্যাসিস্ট্যান্ট-এ্যাসিন্ট্যান্ট, দুদিন-দুই দিন, দুজন-দুই জন, উপপরিদর্শক-উপ-পরিদর্শক, সহসভাপতি-সহ-সভাপতি ইত্যাদি শব্দ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন বানানে লেখা হয়।
ফলে আমাদের বিভ্রান্ত না হয়ে কোনো উপায় থাকে না।
সব বিভ্রাট-বিভ্রান্তি এড়িয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা ভাষার বানান, উচ্চারণ, ব্যবহার ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেশের সবাইকে একই মানদণ্ড আওতায় আনতে হবে। আর সেটি বাস্তবায়নের গুরুভার নিতে হবে বাংলা একাডেমিকেই।
নদীর স্রোতের মত ভাষা প্রবাহমান। আজ থেকে ৫০ বছর আগে আমাদের এই ভাষা এরকম ছিল না। নিশ্চয়ই ৫০ বছর পরেও এরকম থাকবে না। ভাষার ধর্মই পরিবর্তন হওয়া। প্রতি সাড়ে ১৬ কিলোমিটার অন্তর অন্তর ভাষার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। স্থান, কাল, পাত্রভেদে ভাষা পরিবর্তিত, পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত হওয়াই স্বাভাবিক। তার মানে এই নয় যে, বর্তমান ফেসবুক ও ভাইবার প্রজন্ম যত্রতত্র যে জগাখিঁচুড়ি ভাষা ব্যবহার করছে সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানবো।
বর্তমান এই তরুণ প্রজন্মটা অনেক বেশি আবেগী এবং ফ্যাশন সচেতন। তারা ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী যে গণজাগরণ তৈরি করেছিল তারই মর্মবাণী সারা বিশ্ব আবার নতুন করে জেনেছিল- ‘তুমি কে আমি কে? বাঙালি.. বাঙালি..। ’
বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি ভাসা ভাসা যে ভালোবাসায় প্রকাশ পায় সেটাই মূলত এই মাতৃভাষার সর্বনাশের অন্যতম কারণ। তাই মায়ের ভাষা রক্ষা ও সমৃদ্ধির জন্য ইতিহাসের আহ্বানে রক্তের স্পন্দনে বাঙালির বোধনে আঘাত হানার এই তো সময়, শ্রেষ্ঠ সময়..
বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘণ্টা, ফ্রেব্রুয়ারি ০১, ২০১৫