ঢামেক বার্ন ইউনিট ঘুরে: ‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। জীবনে কখনো কোনো মিটিং-মিছিলেও যাইনি।
একটা জল-জ্যান্ত মানুষের গায়ে পেট্রোল বোমা মেরে পুড়িয়ে দিয়ে কী মজাই না তাদের! সারা গা তো জ্বলছে আমার, ওদের কী! আর আপনি তো শুধু প্রশ্ন করছেন। আপনি বলতে পারেন ভাই, কে নেবে এর দায়? ৪৮ শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে কেবল এই প্রশ্নের উত্তর চাই...!’
পোড়া শরীরের তীব্র গন্ধ ও অসহ্য যন্ত্রণা কেবল তিনিই বোঝেন, যার শরীর পুড়েছে। যন্ত্রণায় মাঝে-মধ্যে ‘আহ্’ করে চিৎকার ও আর আত্মকষ্টের জ্বলনে জ্বলতে থাকা নূর আলম (৪০) কান্না জড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে কথাগুলো বলছিলেন।
মানবতা কতটা নিচে নামলে দেশে এমন কর্মকাণ্ড চলতে পারে, এটাই তার প্রশ্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) চার নম্বর বেডে ভর্তি আছেন নূর আলম। পেশায় রাজউকের সাব-কন্ট্রাক্টর। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে তার বাড়ি।
২৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) যাত্রাবাড়ী কাঠেরপুল এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে পর পর কয়েকটি পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে অবরোধ সমর্থকেরা। ওই বাসের যাত্রী ছিলেন নূর আলম। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে তার মুখ, বুক, পিঠ ও দুই হাতের পুরোটাই পুড়ে গেছে। পুরো শরীরেই ব্যান্ডেজ।
আহাজারি আর চিৎকার চলছে অনবরত। হঠাৎ অস্থিরতা এতটাই বাড়ে যেন পৃথিবীর সব রং কালো হয়ে আসে। এসব দেখে পাশে বসে স্ত্রী চম্পা শুধুই কাঁদেন।
নূর আলম বলেন, আমি অসুস্থ নই। কোনো বড় রোগও হয়নি কোনোদিন। তবে কী অজানা পাপের ফলে আমার জীবনটা পুড়লো! তারা (রাজনৈতিক দল) ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু আমাদের পুড়িয়ে কেন? এর সমাধান কোথায়?
নূর আলমের প্রতিটা কথাতেই ক্ষোভ আর প্রশ্ন। তার সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। কী ঘটে গেল তার জীবনে! নিজেও জানেন, শরীরের ৪৮ শতাংশ পোড়া কতটা ঝুঁকির। কী জীবন ছিল তার আর কী হয়ে গেল!
ছল ছল চোখে নূর আলম বলেন, রাজনীতি করবেন নেতারা আর পুড়তে হবে আমাদের! আমাদের পুড়িয়ে তারা ক্ষমতা নেবেন। আমি কি তাদের ক্ষমতার আশেপাশে আছি? সেদিন (ঘটনার দিন ২৩ জানুয়ারি) তো বাসায় ফিরছিলাম। এটা কী দোষের কিছু ছিল! দয়া করে এর একটা সমাধান করুক সরকার। আপনারা একটা ব্যবস্থা নেন, উদ্যোগ নেন। এ যন্ত্রণা আর সইতে পারিনা।
নূর আলমের স্ত্রী চম্পা বাংলানিউজকে বলেন, যারা পেট্রোল বোমা মারে, তারা মানুষ না। তাদের ধরে সবার আগে পোড়ানো উচিত। তাহলে তারা বুঝতে পারবে, দগ্ধ হওয়ার কী জ্বালা-যন্ত্রণা। এখন আমার ভবিষ্যত কী হবে? সংসারের কী হবে? বলতে পারেন কেউ?
এদিকে, বার্ন ইউনিটের হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের এক সেবিকা বাংলানিউজকে বলেন, তিনিসহ আরো কয়েকজন নার্স এই ইউনিটে কাজ করছেন। প্রথম যেদিন নূর আলম এখানে এলেন, তার অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক ছিল। বর্তমানে তিনি সেই শঙ্কা কাটিয়ে উঠেছেন। তবে তার উন্নতি হচ্ছে বেশ ধীরগতিতে। আরো অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হবে তাকে।
অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর বিভিন্ন সহযোগিতা পেয়েছেন উল্লেখ করে নূর আলমের স্ত্রী চম্পা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর তহবিল, বসুন্ধরা গ্রুপ ও এমপি-মন্ত্রীরা সহযোগিতা করেছেন। এই বিপদে আর্থিক সহযোগিতাগুলো কাজেও লেগেছে। কিন্তু এভাবে কারো কাছ থেকে কোনোদিন আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিতে হবে, এমন দিন তো আমরা চাইনি।
এ সময় নূর আলম বলে ওঠেন, ভালোই তো ছিলাম। কোনো কিছুরই অভাব ছিল না আমার সংসারে। আমি তো রাজনীতি করিনা, রিজভী-হানিফ চিনি না। কিন্তু কোন কারণে আমাকে পোড়ানো হলো।
ওহ! আল্লাহ আর ভালো লাগে না...! কী করেছিলাম আমি! এভাবে আমার মতো মানুষদের পুড়িয়ে দেশের রাজনীতি কোন অভিশপ্ত পথের দিকে হেঁটে চলেছে, আপনি বলতে পারেন?
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৫