ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ছেলেরা বীভত্স বাবাকে দেখে ভয় পায়!

সৈয়দ ইফতেখার আলম, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫
ছেলেরা বীভত্স বাবাকে দেখে ভয় পায়! ছবি: আনন্দ / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢামেক বার্ন ইউনিট ঘুরে: কান থেকে পুঁজ বের হচ্ছে। নাক থেকেও তাই।

আঠালো রসে ব্যান্ডেজ করা দুই হাতের গোড়া থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে দুর্গন্ধময় রস। আর সারা শরীরে অসহ্য জ্বালা-যন্ত্রণা তো রয়েছেই। দীর্ঘ কয়েকটি দিনরাত এভাবেই কাটছে তার। যেন না বলা হাহাকার। আর কি পাপের ফসল তাই ভেবে বিষোদগার।

মো. সালাউদ্দিন (৩০) নাম তার। এতো কিছুর পরও তার সবচেয়ে বড় কষ্ট ক্লাস সিক্সে পড়া দুই ছেলে সন্তান, তাকে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠছে। তিনিও আগের মতো বাবার সুরে দুই সন্তানকে ডাকতে পারছেন না! আকাশের কালো মেঘ যেন তার শরীর জড়িয়ে জীবনেও লাগিয়েছে বিষন্ন অনিশ্চয়তা।

কী আছে সামনে? কী হবে এরপর? বলেন মো. সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি।

সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া স্বামীর মুখমণ্ডলে মলম লাগাচ্ছেন আর বাংলানিউজকে বলছেন, ভালো মানুষটার আজ কি যে হয়ে গেল! কোন আগুনে পুড়লো সে, রাজনীতির নাকি ক্ষমতার? এসব ভাবতেও চাই না। শুধু ভাবতে চাই, কি দোষে এমন পরিণতি আমাদের!

স্ত্রী উর্মি বলেন, তার স্বামী সালাউদ্দিন কথা বলতে পারেন না, ‘আ-আ-আ’ করে দুই একটা শব্দ বলেন। যা মুখের কাছে কান পেতে শুনতে হয়। ঠিকভাবে চোখ খুলতে পারেন না। এমনকি ঠিক মতো খেতেও পারছেন না। খাবারে নেই রুচিও। মাথা থেকে পেট পর্যন্ত সম্পূর্ণ পোড়া। এতে কি যে জ্বালা হয় ওনার, এটা তার কাঁপুনি-ঝাকানি দেখলেই টের পাই। দিনে হঠাৎ হঠাৎ ১০৩/১০৪ ডিগ্রি জ্বর চলে আসে। চিৎকার করে যে কষ্ট-জ্বালা-বেদনা প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করবেন, তারও সুযোগ নেই। পুড়ে গিয়ে কথাই তো বলতে পারেন না!!!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট বা এইচডিইউ'র (high dependency unit) এক নম্বর বেডে আছেন মো. সালাউদ্দিন। রাজধানীর এলিফেন্ট রোডের সিটি সুপার মার্কেটে চাকরি করেন। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে। গত ২৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) রাজধানীর যাত্রাবাড়ী কাঠেরপুল এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে পরপর কয়েকটি পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে অবরোধকারীরা। আর ওই বাসের এক হতভাগ্য যাত্রী ছিলেন এই সালাউদ্দিনও। ২৮ শতাংশ বার্ন তার শরীরে। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে তার মাথা, মুখ, বুক, পিঠসহ দুই হাত পুরোটাই পুড়ে গেছে। গলা থেকে বুকে ব্যান্ডেজ।

‘সংসারে দুই ছেলে। ওরা দুইজনই ক্লাস সিক্সে পড়ে। এখন কি হবে ওদের ভবিষ্যত’ বিষয়টি উল্লেখ করে মো. সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মি বলেন, ক্লাস সিক্সে পড়া দুই ছেলে হাসিব-আবিদ। সঙ্গে বেকার দেবর আল-আমীনও। স্বামীর একার রোজগারে চলতো সংসারটা। এখন কতো দিনে তিনি সুস্থ হবেন, আর কতোদিনে আমরা আগের মতো স্বাভাবিক হবো, কিচ্ছু মাথায় আসছে না। ছেলে দুইটা দাদী ও ছোট ফুপির কাছে আছে। তারাও ভয়ে-কষ্টে বাসায় কেবলই কান্নাকাটি করছে। এদিনে আমি ও আমার দেবরের টানা হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। কবে সুস্থতা আসবে জানি না। এতো কেন অনিশ্চয়তা ভর করলো আমাদের জীবনে? আমাদের পরিবারের সবাই তো এখন অন্ধকারে আছি। শুধু আমরা কেন, আমাদের মতো এমন অনেক পরিবারই অগ্নিদগ্ধ হয়ে আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত। অগ্নিদগ্ধ অনেক পরিবারের সদস্য তো পৃথিবী ছাড়া হয়েছে, আমরা তো সাফার করছি। কি হবে আমাদের!

এই অন্ধকার থেকে তাদের উত্তরণের পথ কি? মো. সালাউদ্দিনের স্ত্রী উর্মির এ প্রশ্নের উত্তর তারাই দিতে পারবেন যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে উর্মির করজোড়ে মিনতি, এই বোমাবাজি অন্তত বন্ধ হোক।

উর্মি বলেন, আমার দুই ছেলে নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজারের হাজী সাহেব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস সিক্সে পড়ে। রাতে ঘুমাতে পারে না ওরা। হাসপাতালে একদিন বাবাকে দেখতে এসেছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। তাই এখন আর আসতে দেই না। বাসায় বসে কেবলই কান্নাকাটি করে।

উর্মির কাতর প্রশ্ন, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা এমন রাজনীতিই করেন- যেখানে ছেলে বাবাকে দেখলে ভয় পাবে? তারা এমন করে দেন মানুষ পুড়িয়ে? আর কতো এভাবে? আর কতো পরিবারকে মেরে ফেলে, পুড়িয়ে অন্ধকারে ফেলা হবে!

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।