ঢাকা, বুধবার, ০ মাঘ ১৪৩১, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

গোলাপীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেন ফোরকান

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫
গোলাপীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেন ফোরকান

ঢাকা: ফোরকান মল্লিকসহ রাজাকাররা স্থানীয় যোগীবাড়ির সুপারি বাগানে নিয়ে গোলাপীকে ধর্ষণ করেন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ির সামনে ফেলে যান।

শেষ রাতের দিকে গোলাপী রানীর মৃত্যু হয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন কবিরাজ শান্তি রঞ্জন দে। তিনি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী।

সোমবার (২ ফেব্রুয়ারি) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন কবিরাজ শান্তি রঞ্জন দে। সাক্ষ্যগ্রহণে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নি। সাক্ষ্য শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় মঙ্গলবার (৩ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

 
বর্তমানে ৬৩ বছর বয়সী সাক্ষী শান্তি রঞ্জন দে পটুয়াখালীর মীর্জাগঞ্জ উপজেলার সুবিদখালী গ্রামের বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সুবিদখালী রহমান ইসহাক পাইলট বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়তেন। তখন থেকেই ছাত্রলীগ করতেন।
 
সাক্ষী বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিলের পর পাকিস্তানি সেনারা মির্জাগঞ্জে এলে স্থানীয় মুসলিম লীগের সদস্যসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন। পাকিস্তানি বাহিনী স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটি, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে।
 
আসামি ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদারসহ এলাকার অনেকেই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সুবিদখাল বাজারের পুরাতন হাসপাতালে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
 
সাক্ষী আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদার, দবির শিকদারসহ সশস্ত্র রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা গানবোটে করে সুবিদখালী বাজারে আসে। বাজারে এসেই রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মির্জাগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের জমাদ্দার ও ডাক্তার দেবেন্দ্র সরকারকে আটক করে তাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে।
 
এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের একজন দেবেন্দ্র ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে গুলি করে। এ সময় তার স্ত্রী বিভা রানী স্বামীকে জড়িয়ে ধরলে ফোরকান মল্লিক তার হাতে থাকা বেয়নেট দিয়ে বিভা রনীর বুকে আঘাত করেন। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
 
এ ঘটনার পর কাদের জমাদ্দারকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তার দোকানে গিয়ে লুটপাট করে। সেখান থেকে রমেশ চন্দ্র বণিকের দোকানের ক্যাশ লুট করে কাদের জমাদ্দারকে সঙ্গে নিয়ে গানবোটে করে পটুয়াখালীর দিকে রওনা হয়।
 
সাক্ষী বলেন, এরপর আমি দৌঁড়ে গিয়ে ডাক্তার শ্যাম সুন্দর কুণ্ডুকে (এমবিবিএস) সঙ্গে নিয়ে এসে দেবেন ডাক্তার ও তার স্ত্রী বিভা রানীকে দেখাই। ডাক্তার উভয়কেই মৃত ঘোষণা করে চলে যান। এ ঘটনার দিনই বিকেল চারটার দিকে পায়রা নদীর দিক থেকে কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পাই। পরে লোকমুখে জানতে পারি, কাঁকড়াবুনিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজ খলিফা এবং কাদের জমাদ্দারকে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে লাশ পায়রা নদীতে ফেলে দেয়।
 
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদারসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার রাধেশ্যামের তিন ছেলে রমনী কুণ্ডু, সুনীল কুণ্ডু ও ডাক্তার শ্যাম সুন্দর কুণ্ডুকে ধরে রাজাকার ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যান। এদিন আটককৃত এ তিন ভাইকে জোর করে ধর্মান্তর করে বলেও সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন সাক্ষী।
 
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট রাত আটটার দিকে তিনি তাদের পুরোনো বাড়ি থেকে সুবিদখালী বাজারের বাসায় আসছিলেন। এ সময় দেখতে পান সশস্ত্র রাজাকাররা গোলাপী রানী নামের ১৬/১৭ বছরের একটি মেয়েকে নিয়ে আসছে। রাজাকারদের হাতে থাকা টর্চের আলোতে গোলাপীসহ রাজাকার ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদার ও বেলায়েতকে চিনতে পারেন তিনি।
 
বাসায় যাওয়ার পর প্রতিবেশি রামকৃষ্ণ সাহার বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে সেখানে যান এবং জানতে পারেন রাজাকাররা গোলাপীকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এরপর মাঝরাতে রক্তাক্ত অবস্থায় গোলাপীকে তার বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। বাড়ির লোকজনের কান্নাকাটি শুনে আবার সেখানে গেলে সাক্ষী জানতে পারেন, ফোরকান মল্লিকসহ রাজাকাররা স্থানীয় যোগীবাড়ির সুপারি বাগানে নিয়ে গোলাপীকে ধর্ষণ করেন। শেষ রাতের দিকে গোলাপী রানীর মৃত্যু হয়।
 
এর তিনদিন পর ২০ আগস্ট ভয়েজ অব আমেরিকা শুনতে নারান কর্মকারের বাড়িতে যান সাক্ষী কবিরাজ শান্তি রঞ্জন দে। সে সময় হঠাৎ নারান কর্মকারের প্রতিবেশি ললিত কর্মকারের বাসা থেকে চিৎকার শুনতে পান। ঘর থেকে বের হয়ে দেখতে পান ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান শিকদার, জবেদ আলী, হামেদ আলীসহ কিছু রাজাকার ললিত কর্মকারের অবিবাহিত মেয়ে শোভা রানী এবং তার পুত্রবধূ সুষমা কর্মকারকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
 
পরদিন অসুস্থ অবস্থায় শোভা রানী এবং সুষমা রানীকে তাদের বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। সাক্ষী এবং নারান কর্মকার নিকুঞ্জ ডাক্তারকে এনে তাদের চিকিৎসা দেন এবং তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এর কিছুদিন পর লোকলজ্জা এবং প্রাণভয়ে ললিত কর্মকারের পরিবারের সদস্যরা ভারতে চলে যান।
 
সাক্ষ্যগ্রহণের শেষের দিকে সাক্ষী আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমরা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ১৯৭১ সালে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিপূর্ণ নাগরিকের মর্যাদায় থাকতে চাই।
 
সবশেষে সাক্ষী কবিরাজ শান্তি রঞ্জন দে আসামির কাঠগড়ায় থাকা ফোরকান মল্লিককে শনাক্ত করেন।
 
গত ১৯ জানুয়ারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও দু’জন সাক্ষী। তারা হলেন মো. হাবিবুর রহমান বাদশা ও মোঃ চাঁন মিয়া।

গত ১৯ জানুয়ারি ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণ ও দেশান্তরকরণের ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৮ জনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরকরণ, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরকরণ, ৬৪টি বসতঘর ও দোকানপাটে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ।

এর আগে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। বিপক্ষে শুনানি করেন ফোরকান মল্লিকের আইনজীবী আব্দুস সালাম খান।

গত বছরের ২ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। ১৭ নভেম্বর এ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। পরে তিনি অভিযোগ আমলে নেওয়ার পক্ষে শুনানি করেন।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তদন্ত সংস্থা। ২৮ অক্টোবর এ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে জমা দেওয়া হয়।

গত বছরের ২৬ জুন শুরু করে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত মামলাটির তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।

ফোরকানের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ছইলাবুনিয়া গ্রামে। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বছরের ২৫ জুন সকালে পটুয়াখালী গোয়েন্দা শাখার একটি দল বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফোরকান মল্লিককে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের দায়ে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় তিনি উচ্চ আদালত থেকে ছয় মাসের জামিন নেন। গত বছরের ৩০ মার্চ বিচারিক কার্যক্রম চলাকালে আদালতে হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালে তার বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, খুন, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পান পটুয়াখালীর আদালত। তখন মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার একেএম নাসির উদ্দিন মাহমুদ মামলাটি গত বছরের ২৫ জুন তদন্ত সংস্থার কাছে পাঠান। তদন্ত সংস্থা মামলাটি গ্রহণ করে ২৬ জুন থেকে তদন্ত শুরু করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সত্যরঞ্জন রায়।
 
গত বছরের ৩০ জুন ফোরকান মল্লিককে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখানো (শ্যোন অ্যারেস্ট) ও তদন্তের স্বার্থে ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর আবেদন জানান প্রসিকিউটর প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল। শুনানি শেষে ফোরকান মল্লিককে ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাজির করানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শককে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-২।

৩ জুলাই ফোরকান মল্লিককে হাজির করা হয়ে গ্রেফতার দেখিয়ে (শ্যোন অ্যারেস্ট) কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।