ঢামেক বার্ন ইউনিট ঘুরে: আগুনে পুড়ে কাতরানো জীবনের গল্প রোজই শোনাচ্ছেন তারা। দুঃখ বর্ণনে বেদনা দমে, এই হিসেবে তাদের কথাগুলো, শরীরের জ্বালাগুলো, চোখের জলের ভাষাগুলো খানিক বুলি আউরাচ্ছেন।
নিজের শরীরের পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে জ্বালায় ‘ওরে বাবা রে...’ বলে ওঠা মানুষগুলো বলছেন- এই জ্বালা যেন কোনো চরম শত্রুও না পায়। এমনকি যারা মেরেছেন এই পেট্রোল বোমা, তারা এর জ্বালা বুঝে মারেননি। যদি এর জ্বালা তারা বুঝতেন- ও পথে কখনই যেতেন না!
বর্তমানে মানবিকতার নাগপাশ ছিড়ে রাজনীতি হচ্ছে এমনটাও তারা মানতে রাজি নন। রাজনীতি কল্যাণের। তারা চান- ব্যক্তি জীবনে ন্যূনতম যে কল্যাণ তারা হাড় ভাঙা খাটুনিতে আনতে পারেন, সে কল্যাণে যেন কোনো আঁচড় বসিয়ে উল্টো তাদের জীবনটাকেই লণ্ডভণ্ড করে না দেন রাজনীতিবিদরা।
নিজের শরীরের গন্ধেই যাদের ঘুম আসে না, বর্তমানে দূর আগামীর কল্পনা তো তাদের জন্য বিলাসের। তবুও ভাবতে হয়। ভাবতে হয় মানবিকতার জন্য, মনুষ্যত্বের জন্য। থেকে থেকে পোড়া অঙ্গের তীব্র জ্বালা আর শ্বাস বন্ধ হওয়া খিঁচুনিতে থাকা ৭০ বছরের আবু তাহের (১৪ শতাংশ বার্ন), ২৮ শতাংশ বার্ন সালাউদ্দিন (৩০), ১৭ শতাংশ বার্ন মাসুদ (৩৫), ২০ শতাংশ বার্ন খোকন (৩০), ১৪ শতাংশ বার্ন ওসমান গনি (৪০) ও ০৯ শতাংশ বার্ন ইয়াসিন আরাফাত (৩০) ছাড়াও আরও অনেকেই রয়েছেন এই তালিকায়। যারা জানাচ্ছেন- দেশেটাকে নরক না বানানোর আকুতি। তারা কেউই চান না, যে পরিস্থিতির মুখোমুখি আজ তারা হয়েছেন আর কোনো মায়ের সন্তান সে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ুক।
এরমধ্যে এইচডিইউ’র চার নম্বর বেডে ভর্তি থাকা ৪৮ শতাংশ বার্ন নূর আলম (৪০) রোববার (০১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে মারা যান। এরআগে ৩০ জানুয়ারি নূর আলম বাংলানিউজকে বলেছিলেন, ‘ওহ! আল্লাহ আর ভালো লাগে না...! কী করেছিলাম আমি! এভাবে আমার মতো মানুষদের পুড়িয়ে দেশের রাজনীতি কোনো অভিশপ্ত পথের দিকে হেঁটে চলেছে, আপনি বলতে পারেন?’
তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু একটা প্রশ্ন যে তিনি করে গেলেন (মানুষ পুড়িয়ে রাজনীতি কোনো অভিশপ্ত পথের দিকে হেঁটে চলেছে) এর উত্তরটা দেবে কে?
এই তো ৭০ বছরের বৃদ্ধ আবু তাহের। গত ১৭ জানুয়ারি (শনিবার) পাবনা থেকে ঢাকায় আসেন। নামেন গাবতলীতে। যাবার কথা ছিল মোহাম্মাদপুরে। যেতে পথে তার লোকাল বাস লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা। সেই থেকে কথা বন্ধ! শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটের প্রথম বিছানায়। পেশায় কৃষক। তার স্বজনরা বলছেন- যারা বোমা মারার আদেশ দেন আর যারা মারেন, তাদের তো কিছু না। যত জ্বালা আমাদের মতো চাষা-ভুষা, কৃষকের। অভাবের জ্বালা, আবার আগুনে পুড়ে শরীরের জ্বালা! এই বুড়ো বয়সের মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটিকে পুড়িয়ে কি লাভ হলো তাদের!!!
বগুড়ার কাহালু থানার মাসুদ (৩৫)। পেশায় ট্রাক চালক। জীবিকার টানে ট্রাক নিয়ে বেরিয়েছেন। বুঝতে ভুল করেছিলেন বলে এখন মনে করেন। কি ভুল তার? প্রশ্ন করতেই তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অবরোধে গাড়ি না বের করে, না খেয়ে মরতাম। ওটাই ঠিক ছিল। গাড়ি বের করাতে পুড়ে মরতে হবে এই ভুল ছিল বোঝার। ও ভাই, আগুনে পুড়ে ভয়ানক হয়েছি। অহস্য-তীব্র জ্বলনে আর ভাল্লাগেনা! ওরে বাবারে...
গুলিস্তানের ফুটপাতের জুতার ব্যবসায়ী খোকন (৩০)। শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। জানেন না কি হবে ভবিষ্যতে। ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ১ বছর বয়সী মেয়ে আমার। সংসার চলবে কি করে এরপর? আগের মতো কাজে নামতে পারবো? কি নির্দোষ ওরা, জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে দেয়। এটা আপনি-আমি পারতাম করতে? তবে ওরা কেমন করে করলো? আমার ভবিষ্যতের চেয়ে এটাই বড় প্রশ্ন আমার!
ইয়াসিন আরাফাত। পেশায় ফার্মাসিস্ট। পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়েছেন ২৩ জানুয়ারি (শুক্রবার)। তার বৃদ্ধ বাবা আবু বকর সিদ্দিক (৬৩)। তিনি পেশায় শিক্ষক। মাতুয়াইল বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। তিনি ছেলের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রাজনীতির মানুষ না। বুঝিও না। শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর। তাই সব ব্যর্থতা আমাদের। যারা বোমা মারে তারাও তো কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র, আমরা মানুষ গড়ার কারিগররাই তাদের বোধহয় গড়তে পরিনি। নইলে একটা পশুরও মানবিকতা বোধ রয়েছে। তাদের তো দেখি না। আমার ছেলে তো ২৩ জানুয়ারি পুড়লো। কিন্তু ২৩ তারিখের পরও কেন আরও মানুষ পুড়লো দেশে, এখনও কেন পুড়ছে? কারণ তাদের মানবিকতা নেই। এসব তাদের মজা! কি যে কষ্ট, আল্লাহ...। একবার যদি তারা বুঝতো!
বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পাল বাংলানিউজকে বলেন, এই ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের আগে কখনও পড়তে হয়নি। তবে স্বাভাবিক রোগী সব সময়ই ছিল। এবার পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ যেমন বেড়েছে আমরাও আমাদের জায়গা থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের দ্রুত সুস্থ করে তুলতে।
তিনি বলেন, এই জন্য আমরা মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষানবীস চিকিৎসক, মন্ত্রণালয়ের নির্দশেক্রমে চিকিৎসক বৃদ্ধি করার মতো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছি। এখানে আসা প্রতিটি রোগীকে বেশ কয়েকটি ধাপে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সার্বিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
আগুনে পুড়ে ভয়ানক এই মানুষগুলো সারা বাংলার খণ্ড চিত্র মাত্র। প্রতিদিনই সহিংসতায় দেশের কোথাও না কোথাও পুড়ছে মানুষ। সেই সঙ্গে দগ্ধ হচ্ছে মানবিকতা। আর কত? আর কত সুস্থ মানুষকে পুড়িয়ে মেরে কিংবা বীভৎস করে চলবে দেশের রাজনীতি, সে প্রশ্নই বার্ন ইউনিট বাসিন্দাদের!
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০১৫