বাগেরহাট: টানা অবরোধ-হরতাল ও অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভরা মৌসুমেও পর্যটক শূন্য ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজসহ বাগেরহাটের দর্শনীয় স্থানগুলো।
হাতেগোনা কয়েকজন স্থানীয় এবং আশপাশের জেলার দর্শনার্থী এলেও তা একেবারে নগণ্য।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের লাগাতার সহিংস অবরোধে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প।
পর্যটক না থাকায় সরকারও হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
এ অবস্থায় চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহান (র.)’র মাজার, নয়গম্বুজ, রণবিজয়পুর মসজিদ, সুন্দরবনসহ বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) কেন্দ্রগুলো পুরো শীত মৌসুমেও পর্যটকহীন থাকছে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, শীত মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) সুন্দরবনে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে সবচেয়ে বেশি।
অন্য সময় এ মৌসুমে সুন্দরবনের করমজল, হারবাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, কটকা কচিখালী এলাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা আর টানা অবরোধে কমে গেছে পর্যটকদের উপস্থিতি।
undefined
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমির হোসেন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি- এই তিন মাস সুন্দরবনে পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি আসেন। গত পর্যটন মৌসুমেও (শীত মৌসুমে) রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকায় সুন্দরবনে পর্যটকদের আগমন ছিল খুব কম।
যদিও ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল সুন্দরবনে। তবে এবারের অবস্থা খুব খারাপ। জানুয়ারি থেকে প্রায় পর্যটন শূন্য সুন্দরবন।
তিনি বলেন, মূলত চিত্ত বিনোদনের জন্য পর্যটকরা সুন্দরবনে বেড়াতে আসেন। বর্তমানে সারাদেশে জীবনের ঝুঁকি ও পেট্রোল বোমা আতঙ্ক। প্রয়োজন ছাড়া কেউই বের হচ্ছেন না। সেখানে কেউই এখন আর পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে আসতে সাহস পাচ্ছেন না।
আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, চলতি জানুয়ারি মাসে পূর্ব সুন্দরবনে বিদেশি পর্যটকদের উপস্থিতি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। একইসঙ্গে দেশি দর্শনার্থী ও পর্যটকরাও নেই। আশেপাশের জেলা ও উপজেলার হাতেগোনা স্থানীয় দর্শনার্থী করমজল ও হাড়বাড়িয়ায় আসছেন। তবে এ সংখ্যাও খুবই কম।
এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মৌসুমে লক্ষ মাত্রার ৫০ শতাংশ রাজস্ব আদায় করাও প্রায় অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন আমির হোসেন।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন ও বন্য প্রাণি প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) প্রল্লাদ চন্দ্র রায় জানান, এ মৌসুমে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার পর্যটকের উপস্থিতি থাকে এ কেন্দ্রে। কিন্তু গত কয়েকদিনে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জনে।
undefined
হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছরও এই পর্যটন কেন্দ্রের রাজস্ব আয় ৪০ লাখ টাকা থেকে কমে ২০ লাখ টাকায় নেমে এসেছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ লাখ টাকা। এ রকম পরিস্থিতি চললে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এবারও রাজস্ব অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।
এদিকে, পর্যটক না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল লঞ্চ ও টুরিস্ট বোট (জালি বোট) মালিকরা। লোকসান গুণতে হচ্ছে তাদেরও।
এ ব্যাপারে গ্রিন হলিডেস ট্যুরস’র প্রধান নির্বাহী বোরহান উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে শুধু সুন্দরবনে চলতি জানুয়ারিতে আমাদের পাঁচটি বড় রকমের দেশি-বিদেশি গ্রুপের নিশ্চিত ট্যুর বাতিল হয়েছে। আমাদের সব আয়োজন ঠিক ছিল। এভাবেই বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।
দ্য বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, চলমান পরিস্থিতিতে বিদেশি পর্যটকরা আসতে সাহস পাচ্ছেন না। ভরা মৌসুম হলেও পর্যটকের অভাবে এখন ট্যুর পরিচালনা করতে পারছেন না।
এই পরিস্থিততে এরইমধ্যে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের সুন্দরবনের ট্যুরগুলোও বাতিল করা হচ্ছে বলে জানান বেঙ্গল ট্যুরস’র ওই কর্মকর্তা।
মংলা টুরিস্ট বোট (জালি বোট) মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসাইন মোহাম্মদ দুলাল বাংলানিউজকে জানান, মংলায় প্রায় দুইশ ৫০ থেকে তিনশ টুরিস্ট বোট, লঞ্চ ও অন্যান্য নৌযান রয়েছে। এতে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে কোনো পর্যটক না থাকায় আয়ও নেই।
পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বোটের কর্মচারীরা। মালিকরাও হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত।
মংলায় বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল পশুর’র ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক বাংলানিউজকে জানান, মৌসুমের এ সময় তাদের হোটেলের ১৬টি কক্ষই পূর্ণ থাকে। কক্ষ খালি না থাকায় প্রতিদিনই ১৫ থেকে ২০ জন পর্যটককে ফিরিয়ে দিতে হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে এখন কোনো পর্যটকই পাওয়া যাচ্ছে না।
এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি মাসে ছয় লাখ টাকারও বেশি ক্ষতি হবে বলে জানান তিনি।
একই অবস্থা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খানজাহানের মাজার, অযোধ্যা মঠসহ পাশের পার্ক ও রিসোর্টগুলোতে। কমে গেছে দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন।
এর প্রভার পড়েছে স্থানীয় দোকান মালিক থেকে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীদের ওপর।
ষাটগুম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন দোকান মালিক নাজমুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর এ সময় প্রতিদিন আট থেকে দশ হাজার টাকার বেচাকেনা হতো। কিন্তু এ বছর দোকান প্রতি একশ থেকে দুইশ টাকার বেশি বেচাকেনা হচ্ছেনা। এতে সংসার চালানো দুরুহ হয়ে পড়েছে।
বাগেরহাট ষাটগুম্বুজ প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ থেকে ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু লাগাতার অবরোধ-হরতালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
বাগেরহাটের সুন্দরবন রির্সোট অ্যান্ড পিকনিক কর্ণারের সত্ত্বাধিকারী মোশাররফ হোসেন মুক্ত বাংলানিউজকে বলেন, পর্যটন শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। গত বছরের ব্যবসার তুলনায় এবার ১০ শতাংশ হয়নি। আমরা এই ক্ষতি সহজে কাটিয়ে উঠতে পারব না। লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আমরা বসে থাকি শীতের এই মৌসুমের জন্য। আর এ মৌসুমেই চলছে অবরোধ।
অবিলম্বে এই অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সরকারের প্রতি সব পর্যটন কেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়ারও দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাটের হয়রত খানজাহান (র.)’র মাজার সংলগ্ন হোটেল অভির (আবাসিক) সত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ হুদা বাংলানিউজকে বলেন, বাইরের পর্যটক-দর্শনার্থীরা না থাকায় হোটেলের ৬০টি আসনের প্রায় সবগুলোই এখন ফাঁকা রয়েছে। এই অবস্থায় কর্মচারীদের বেতন দেব কীভাবে তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
তিনি আরো বলেন, এ অবস্থায় শুধু এ খাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যবসায়ীরাই নয়, এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পর্যটন মৌসুমে পর্যটক না থাকায় সার্বিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে এখানকার অর্থনীতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৩২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৫