ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

পেট্রোল বোমায় নিহত ৩

এর কি কোনো বিচার নেই?

রেজাউল করিম বিপুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৫
এর কি কোনো বিচার নেই? ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফরিদপুর: কি অপরাধ, কি অন্যায় করেছিল আমার স্বামী। কি দোষ ছিল আমার অসহায় বৃদ্ধ বাবার।

আমার ঘুমন্ত বাপকে আমি ডেকে তুলে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি। আমার স্বামীর সঙ্গে বাপকেও পুড়িয়ে মেরেছে ওরা।

একি সর্বনাশ করলো আমার। এর কি কোনো বিচার নেই?  আমার সন্তানেরা কাকে বাপ বলে ডাকবে? কে নেবে ওদের খোঁজ। কে দেখভাল করবে তাদের?

স্বামী মারা গেলে বাপের কাছে আশ্রয় হয় মেয়েদের। ওরা যে আমার বৃদ্ধ বাপকেও পুড়িয়ে মেরেছে। আমি এখন কি নিয়ে বাচঁবো? কে দেখবে আমার ইভা ও ইলাকে? ওদের যে কেউ আর রইলো না।

বাংলানিউজকে আর্তনাদ করে কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের গৌরনদীতে ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পুড়িয়ে মারা ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রামের ট্রাকচালক ইজাজুল ইসলামের স্ত্রী পারভীন বেগম রিতা।

শনিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) ভোরে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর বাজার এলাকায় হরতাল-অবরোধকারীরা ট্রাকে আগুন দিলে মারা যান ট্রাকচালক ইজাজুল ইসলাম (৩৫), হেলপার একই এলাকার মন্নু বিশ্বাস (৪৫) ও  ট্রাকে থাকা ইজাজুলের শ্বশুর মোতালেব শেখ (৬৫)।  

রিতা বেগমের আর্তনাদে বাড়িতে ভিড় করেছেন পাড়া প্রতিবেশীরা। কেউ কেউ সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো সান্তনার বাণীই যে কাজে আসছে না।

জানা গেছে, রাত ১টার দিকে মোতালেব তার শাশুড়িকে আনতে মেয়ে-জামাইয়ের ট্রাকে উঠে বরিশাল যাওয়ার উদ্দেশে ফরিদপুরের ডোমরাকান্দি এলাকা থেকে রওনা হন। বরিশালের গৌরনদীতে পৌছামাত্রই এ সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

রিতা আর্তনাদ করে বলেন, ১০/১২ দিন আগে পেটের দায়ে সন্তানদের খাবার যোগাতেই তো ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়েছিলেন ইজাজুল। কতোদিন ধরে তার মুখটা দেখি না। যে হারায়, সেই বুঝে তার স্বজন হারানোর বেদনা। আপনারা কেউ বুঝবেন না।  

ইজাজুল ফরিদপুরের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেনের (জাহাঙ্গীর টিএসআই) ছেলে। ৪ ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন তিনি। পরিবারে স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে ইলা ওরফে চৈতী (৯) স্থানীয় ডোমরাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট মেয়ে ইলার বয়স তিন বছর।

ইজাজুলের স্ত্রী রিতা বেগমের কাছ থেকে জানা গেছে, দুই মেয়ে নিয়ে এই দম্পতি ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রামের আবুল হোসেনের একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকেন। স্বামীর রোজগারেই চলতো সংসার। দুই সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার আর কোনো অবলম্বন রইল না তার।  

ওই গাড়িতেই পুড়ে মারা যান হেলপার মুন্নু বিশ্বাস (৪৫)। তিনি ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মোল্যাবাড়ী সড়কের (বিহারি কলোনি) এলাকার মৃত কাদের বিশ্বাসের ছেলে। তার পরিবারে দুই ছেলে। বড় ছেলে পাপ্পু বিশ্বাস (২৫) এসিআই কোম্পানির গাড়িচালক। ছোট ছেলে হাদী বিশ্বাস (২০) রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করেন বলে জানা গেছে।

রিতা বলেন, তার স্বামী দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পরিবহন শ্রমিকের কাজ করে আসছেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতেদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে শাস্তির দাবি জানান।

তিনি বলেন, আজ স্বামীর বাড়িতে ফেরার কথা ছিল। ঠিকই ফিরছে, কিন্তু লাশ হয়ে।  

নিহতের মা জরিনা বেগম দেশের বর্তমান অবস্থার প্রশ্ন তুলে বলেন, আজ যে সাংবাদিকরা ছবি তুলতে এসেছেন, তারাও তো কোনো মায়ের সন্তান। তারাও ফিরে গিয়ে কাজ করতে পারবেন কি-না, সে অবস্থা নেই।

তিনি বলেন, তবে এমন অবস্থার কেন অবসান হয়নি? কেন এমন হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

বৃদ্ধ মা কান্না জড়িত কন্ঠে চিৎকার করে বলেন, আর কোনো মা সন্তান, কোনো স্ত্রী তার স্বামী অথবা সন্তান তাদের পিতা হারানোর আগেই বিচার করতে হবে।   

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মুন্নুর বোন পারভীন বেগম দাবি করে বলেন, আর কতো বোন তার ভাইকে হারালে তিনি ব্যবস্থা নেবেন? আমরা আমার ভাই হত্যার বিচার চাই। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চলছে দেশে। শিগগিরই এর একটি বিহিত করতে হবে, যাতে করে আর একজন স্বজন আমাদের হারাতে না হয়।

নিহত পরিবারগুলোকে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর নির্দেশক্রমে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক সরদার সরাফত আলী।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।