ঢাকা, রবিবার, ৪ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলে পরিস্থিতি শান্ত হবে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫
যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিলে পরিস্থিতি শান্ত হবে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত ফাঁসি ও জঙ্গি জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করলে বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে মত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
 
রোববার (১৫ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় জাদুঘরে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ’ ৭১ আয়োজিত ‘সন্ত্রাস, সহিংসতা ও জাতীয় নিরাপত্তা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ মতামত দেন।


 
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দু’টি পরামর্শ দিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. ফরাস উদ্দিন আহমেদ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পরই সহিংসতা শুরু হয়। যাদের বিচার হয়নি তাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা এবং সাজাপ্রাপ্ত ২-৪ জনের ফাঁসি দিয়ে দিলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
 
তিনি বলেন, যারা সংলাপের কথা বলে তারা দেশ ও সমাজের শত্রু। সংলাপ বাদ দিয়ে সহিংসতাকারীদের উপযুক্ত ওষুধ দিতে হবে।

ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক চাষীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে অনুরোধ জানান তিনি।
 
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সন্ত্রাসী সরকারকে তাদের কঠিন আঘাত করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
 
সংলাপ সম্পর্কে তিনি বলেন, সংলাপ করার আগে সহিংসতাকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। মন্ত্রী-এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরও বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সরকার উৎখাত ও সহিংসতায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা জড়িত।
 
তিনি বলেন, শুধু পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে জামায়াতকে আইএসআইসহ বেশ কয়েকটি বিদেশি সংগঠন অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের প্রথম কাজ হবে, জামায়াত নিষিদ্ধ করা।
 
জামায়াত নিষিদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করলে সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও মনে করেন আবদুল মান্নান।
 
বৈঠকে দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকার চলতি সংখ্যায় দেশের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক খবর প্রচারের বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রতিবাদ করার আহবান জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান।

একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্প্রচার অনুবিভাগ নামে যে বিভাগ রয়েছে তার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।

মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা চলতি সংখ্যার ২৩তম পাতায় বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে উস্কে দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে।

দেশের বিরুদ্ধে বিকৃত খবর প্রকাশের মাধ্যমে খালেদা জিয়া ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান।

মিজানুর রহমান প্রশ্ন করে বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈদেশিক সম্প্রচার অনুবিভাগ নামে কিছু একটা ছিল। সেটা কি এখনো কাজ করে?

তিনি আরও প্রশ্ন করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি এ বিষয়ে খোঁজ রাখেন? তথ্য মন্ত্রণালয় কি শুধু বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে বেড়ায়? নাকি একটি জাতি ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যার প্রতিবাদ করতে হয়, সেটা কি ভুলে গেছে?

দেশ ও দেশের বাইরে এসব উস্কানি যারা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহবানও জানান মিজানুর রহমান।

বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গোলাবারুদ দেওয়া হয় মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য নয়। এর মানে এই নয় যে, যত্রযত্র গুলি ব্যবহার করতে হবে।
 
তিনি বলেন, সর্তক হয়ে গুলি করতে হবে যাতে নিহত না হয়ে আহত হয়। পেট্রোল বোমা নিক্ষেপকারীকে আদালতে উপস্থাপন করতে পারলে কোনো সন্দেহ থাকবে না। মৃতদেহ হাজির করতে থাকলে সন্দেহের তীর আপনাদের দিকেও যাবে।
 
সংলাপ সম্পর্কে মিজানুর রহমান বলেন, সংলাপের আগে প্রথম কাজ হবে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, পেট্রোল বোমা, সহিংসতা বন্ধ এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা।
 
আমাদের দেশে এতো সন্ত্রাস, এতো জঙ্গিবাদ, মানুষের আহাজারি, এরপরও কি তাদের (সন্ত্রাসীদের) সঙ্গে সংলাপ করতে হবে? যারা সংলাপের কথা বলে তারা কি এসব চিন্তা করে দেখেছেন, কার সঙ্গে সংলাপ করতে হবে?- প্রশ্ন করেন তিনি।
 
সংলাপ করতে হলে প্রথম সমাধান হবে পেট্রোল বোমা, সহিংসতা, সন্ত্রাসকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বলতে হবে, ‘এনাফ ইজ এনাফ, আই অ্যাম সরি’ ক্ষমা চাইতে হবে। এবং বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
 
সংলাপ করতে নাগরিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করবে, এমন খবরের জবাবে তিনি বলেন, সন্ত্রাস, সহিংসতা নিমূর্ল করা না গেলে মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
 
রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরা খারাপ- এ ধারণা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে বর্তমানে ষড়যন্ত্র চলছে। দেশি-বিদেশি এ ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে সবার সহযোগিতা চান মিজানুর রহমান।

প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে মিজানুর রহমান বলেন, আপনি (প্রধানমন্ত্রী) ট্যাক্সের টাকা কেন পেট্রোল বোমায় ক্ষতিগ্রস্তদের দেবেন? যারা পেট্রোল সন্ত্রাসী তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করবেন।
 
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আন্দোলনের নামে যে বর্বরতা হচ্ছে, তা বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে।
 
তিনি বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে পাকিস্তানের মাধ্যমে জামায়াতকে টাকা দিচ্ছে আইএসআই। আর জামায়াত জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
 
শাহরিয়ার কবির বলেন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত জড়িত থাকায় সরকার সহিংসতা রুখতে পারছে না। শিবির জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেলেও সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
 
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আবদুল হান্নান খান যুদ্ধাপরীদের আপিল মামলা বিচারের জন্য আপিল বিভাগে একটি আলাদা বেঞ্চ গঠনের দাবি জানান।
 
তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে বিচার চেয়ে নিতে হয়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সরকারকে উচ্চ আদালত থেকে বিচার চেয়ে নিতে হলে এ বেঞ্চ গঠন করতে হবে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নয়, জনগণের সঙ্গে সরকারকে গণমুখী সংলাপ করতে পারে।
 
র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে সন্ত্রাস দমন আইন প্রয়োগ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে মনে করেন তুরিন। তিনি বলেন, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র জান-মাল রক্ষায় ব্যবহার করতে হবে।

বৈঠকের অন্য বক্তারা বলেন, বর্তমানে দেশব্যাপী বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচির নামে নৈরাজ্যের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা দেশকে অকার্যকর করতে লিপ্ত।

এর মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশের মাটিতে ‘সিভিল ওয়্যার’ শুরু
করার পাঁয়তারা করছে।

এ পাঁয়তারা রোখার পাশাপাশি চলমান রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিক পথে সুরাহা করার মতামত দেন বক্তারা।

সংগঠনের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবীব বলেন, একটি নির্বাচনী বির্তকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলনের সারাদেশে চলা সহিংসতা ও অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালানো হচ্ছে।

এটা কোনো গণতন্ত্রের চর্চা নয়, বরং আন্দোলনের নামে চরম নৈরাজ্য। এ সহিংসতা দেশের সংবিধান ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে আত্মঘাতী এ অপতৎপরতাকে জাতীয় স্বার্থেই বন্ধ করা উচিত। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য হয় না।

হাবিব অভিযোগ করেন, এসব সহিংসতার পৃষ্ঠপোষকরা বরাবর নির্বিকার। তাদের কাছে এ মানবিক বিপর্যয়ের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। রাজনীতির নামে ক্ষমতার পালাবদলের জন্য কোনো নিষ্ঠুর কার্যক্রম, ধ্বংসাত্মক কাজ চালানোর কারো অধিকার নেই।

সংগঠনের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের অব্যাহত সন্ত্রাস, সহিংসতা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিস্থিতির সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি নতুন করে জঙ্গিবাদের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এর উত্তরণ জরুরি। সন্ত্রাসের কাছে আপোস নয়। কারণ, সন্ত্রাসের সঙ্গে আপোস সন্ত্রাসকে বাড়িয়ে তোলে।

কর্মসূচির নামে দেশের ভেতর সিভিল ওয়্যার শুরুর পাঁয়তারাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান বক্তারা।

অবিলম্বে সন্ত্রাস ও বর্ববর্তা বন্ধ না করা হলে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম একাত্তরের রণাঙ্গণের সকল মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে নিয়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার হুশিয়ারি দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে চলমান জাতীয় সংকটের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে জনমত গড়ে তোলার আহবান জানানো হয়।

গোলটেবিল বৈঠকে সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ’র সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন ভাইস চেয়ারম্যান লে. কর্ণেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, সাবেক কূটনীতিক ও সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।