ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

মসজিদেও নৃশংসতা

নিরাপরাধ বাঙালিদের জবাই করতেন সুবহান

উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫
নিরাপরাধ বাঙালিদের জবাই করতেন সুবহান

ঈশ্বরদী (পাবনা): ঈশ্বরদীর প্রায় ৩০ জন নিরীহ বাঙালিকে নিজ হাতে কোরবানির পশু জবাই করার মতো করে হত্যা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় থাকা কুখ্যাত রাজাকার আব্দুস সুবহান।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের এই নায়েবে আমিরের যুদ্ধাপরাধের রায় দেওয়া হবে বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি)।

রায়ের প্রাক্কালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা জেলায় পাবনা জেলায় যুদ্ধাপরাধের হোতা শান্তি কমিটির সম্পাদক ও পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান, রাজাকার-আলবদর বাহিনীর নেতা সুবহানের নৃশংসতার নানা বর্ণনা দিয়ে শহীদ পরিবারের স্বজনেরাসহ ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের মানুষ তার সর্বোচ্চ সাজার রায় আশা করছেন।   

ঘাতক সুবহানের নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে অন্যতম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু বাংলানিউজকে বলেন, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে জন্য ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল ঈশ্বরদীর নিরীহ বেশ কিছু বাঙালি ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেন।

ওই দিন মসজিদ থেকে স্থানীয় মতলেব আহমেদ খান ও তার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলে নাজমূল হক খান হেলালকে টেনে হিঁচড়ে বের করে বর্তমানে ঈশ্বরদী প্রেসক্লাব ভবনের পাশের বধ্যভূমিতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন সুবহান।

একাত্তর সালের ১২ এপ্রিলের নৃশংস ওই ঘটনার আর একজন প্রত্যদর্শী সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আতম শহীদুজ্জামান নাসিম বাংলানিউজকে বলেন, ওই দিন শহরের শেরশাহ রোডের বাসিন্দা এস এম মোয়াজ্জেম হোসেনকেও মসজিদ থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে একই স্থানে জবাই করেন সুবহান।

তিনি বলেন, আমি নিজে চোখে দেখেছি, সুবহান মসজিদের পাশে শান্তি কমিটির অফিস কাম টর্চার সেল থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে সেখানে গেলেন। এরপর মাথা থেকে টুপি খুলে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে কোরবানির পশু জবাই করার মতো করে মোয়াজ্জেম হোসেনকে জবাই করেন।

মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজ মণ্ডল বাংলানিউজকে বলেন, ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে এভাবে পর্যায়ক্রমে ১৯ জন নিরীহ বাঙালিকে জোরপূর্বক টেনে হিঁচড়ে বের করে হত্যা করেন সুবহান।

এ বধ্যভূমিতে যাদের হত্যা করা হয় তারা হলেন মোয়াজ্জেম হোসেন, আজিজুল গণি চৌধুরী, আজিজুল হক চৌধুরী, আজহার উদ্দিন চৌধুরী, তরুণ হোসেন, বাবর আলী সরদার, মতলেব আহমেদ খান, নাজমুল হক খান হেলাল, রফিক পাটোয়ারী, আব্দুল বারেক খলিফা, শামসুদ্দিন আহমেদ, খোরশেদ আনোয়ার, শফিকুল আনোয়ার মিলু, সাইফুল আনোয়ার মিলু, আমিনুল ইসলাম, আক্তার হোসেন খোকন, জসিম উদ্দিন তালুকদার ও মোকাররম হোসেন।

ট্রাইব্যুনালের আরেকজন সাক্ষী ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলী বাংলানিউজকে বলেন, ওই ১৯ জনের বাইরেও ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা গ্রামে, সাহাপুর ইউনিয়নের সাহাপুর মসজিদ মোড়, মুলাডুলি ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া, রামনাথপুর, পৌর এলাকার অরণকোলাসহ ৫টি বধ্যভূমিতে প্রায় ৩০ জন বাঙালিকে নিজ হাতে হত্যা করেন আব্দুস সুবহান। যুক্তিতলা গ্রামের ৫ জন, সাহাপুরের ২ জন, অরণকোলার ২ জন ও রামনাথপুরের ১ জন বাঙালি তার নৃশংসতার শিকার হয়ে শহীদ হন।

মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান ফান্টু জানান, সে সময় সুবহানের সঙ্গে তার সহযোগী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন খোদা বক্স্, নেছার খাঁ, ইসহাক চেয়ারম্যান, ইসমাইল হোসেন, সাজাহান আলী, হারেজ উদ্দিন, মুজাহিদ, সামাদ মহলদার, আব্দুল হামিদসহ বিহারি ও বাঙালি মিলিয়ে শতাধিক রাজাকার।

মুক্তিযোদ্ধারা জানান, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন এক সহযোগী ছিলেন পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লার মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে আবুল বসর মোহাম্মদ আবদুস সুবহান মিয়া। এলাকায় তিনি ‘মাওলানা সুবহান’ নামে পরিচিত। উর্দুতে কথা বলতে পারদর্শী বলে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় তার ভূমিকা ছিল নীতিনির্ধারকের।

একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার সুবহানের রায়ের দিন ঘোষণার পর মঙ্গলবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঈশ্বরদীর মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, আমরা সুবহানের ফাঁসির রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ট্রাইব্যুনালের সাক্ষীরাও প্রত্যাশা করেন, তার ফাঁসির রায়ই ঘোষনা করবেন ট্রাইব্যুনাল।

শহীদ মোয়াজ্জেম হোসেনের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, একাত্তরের ১২ এপ্রিল তার বাবা জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। সেখান থেকে তাকে টেনে বের করে জবাই করে হত্যা করেন সুবহান।

পরবর্তীতে বাবার মরদেহটিও তারা খুঁজে পাননি। যেখানটায় তার বাবাসহ ১৯ জনকে জবাই করা হয়েছিল, সেখানে ২০১০ সালে সড়ক ও জনপথের অর্থায়নে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

ওই ১৯ শহীদের পরিবার এ স্মৃতিসৌধকেই তাদের বাবার কবর মনে করেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৯ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।