খুলনা: টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির বিরূপ প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের পর্যটনশিল্পে।
ভরা মৌসুমে সুন্দরবনে খুবই কম সংখ্যক দেশি পর্যটকের দেখা মিললেও বিদেশি পর্যটক একেবারেই শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে।
প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শত শত বিদেশি পর্যটকসহ হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী অপরূপ সৌন্দর্যের সান্নিধ্য পেতে সুন্দরবন ভ্রমণ করতে আসেন। কিন্তু বর্তমানে শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি সুন্দরবন হয়ে পড়েছে পর্যটক শূন্য।
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন ও বন্য প্রাণি প্রজনন কেন্দ্রের কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) প্রল্লাদ চন্দ্র রায় বাংলানিউজকে জানান, পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে বিদেশি পর্যটক শূন্য সুন্দরবন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের টানা অবরোধ ও হরতালের কারণে সুন্দরবনের এ অবস্থা বিরাজ করছে।
তিনি বলেন, এই সময়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার পর্যটকের উপস্থিতি থাকে এখানে। কিন্তু হরতাল-অবরোধে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জনে। এদের মধ্যে বিদেশি পর্যটক নেই।
তিনি জানান, হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় গত বছরও এই পর্যটন কেন্দ্রের রাজস্ব আয় ৪০ লাখ টাকা থেকে কমে ২০ লাখ টাকায় নেমে এসেছিল। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৫ লাখ টাকা। এ রকম পরিস্থিতি চললে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এবারও রাজস্ব অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের তথ্য মতে, গত তিন বছরের মধ্যে এখন রাজস্ব আদায় সর্বনিম্ন।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল, কটকা, হাড়বাড়িয়া ইকো-টুরিজম কেন্দ্রসহ ভ্রমণে আসা পর্যটক দর্শনার্থীদের কাছ থেকে গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে বন বিভাগ আয় করে ১ কোটি ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯০ টাকা। কিন্তু ১৪ সালের শেষের দিকে সহিংসতার কারণে ২০১৩-১৪ দর্শনার্থী-পর্যটক কমে যাওয়াতে আয় নেমে আসে ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৬০ টাকায়।
আর চলতি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বনবিভাগের আয় হয়েছে ৪৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৫ টাকা। অবশ্য জানুয়ারি থেকে এক প্রকার পর্যটক শূন্য সুন্দরবন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শীত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মংলা বন্দরসহ সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক। বিশেষ করে বিগত বছরগুলোতে ডিসেম্বর-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সুন্দরবনে পর্যটকদের ভিড় এতটাই বেশি ছিল যে, তাদের নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগের সদস্যরা হিমশিম খেয়েছেন।
বছরের এ সময় সুন্দরবনের করমজল, দুবলারচর, হারবাড়িয়া, হিরণপয়েন্ট, কটকা ও কচিখালী প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে। কিন্তু চলতি বছরে টানা হরতাল-অবরোধে থমকে গেছে পর্যটন শিল্প। এ কারণে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বনবিভাগ।
জানা যায়, মংলা ও খুলনায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০টির অধিক অফিস রয়েছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের।
খুলনার এক্সপ্লোর ট্যুরিজম কর্পোরেশন লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আল-আমিন লিটন বাংলানিউজকে বলেন, পর্যটক না থাকায় লঞ্চগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। অনেকে কর্মস্থল থেকে অন্যত্র চলে গেছে।
তিনি জানান, বর্তমান মৌসুমে হরতাল-অবরোধের কারণে গড়ে তার ৫০-৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, বিদেশি পর্যটকরা মূলত সব খোঁজখবর নিয়ে এবং নিরাপদে ভ্রমণ করা যাবে কিনা তা নিশ্চিত হয়ে তবেই আসতে চান। তারা বর্তমান পরিস্থিতিকে নিরাপদ মনে না করায় আসছেন না।
সুন্দরবনে পর্যটক না থাকায় হোটেলগুলোর ব্যবসায় ধস নেমেছে। প্রতিদিনই বাতিল হচ্ছে বুকিং। বাতিল হচ্ছে বিভিন্ন ইভেন্ট বা অনুষ্ঠানও। অবরোধ-সহিংসতার কারণে ব্যবসা নেমে গেছে অর্ধেকে।
হোটেল ব্যবসার এখন ভরা মৌসুম হলেও শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতায় বেহাল এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনার হোটেল ক্যাসল সালামের ফ্রন্ট ডেক্স অফিসার সাজিদ আহমেদ।
তিনি বলেন, অবরোধ ও হরতালের কারণে হোটেল ব্যবসায় চরম মন্দা যাচ্ছে। আগে যেখানে ১শ’ ভাগ বুকিং হতো এখন সেখানে ১০-২০ ভাগ বুকিং হচ্ছে।
অবরোধ ও হরতাল এভাবে চলতে থাকলে এই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা মালিক পক্ষের জন্য কঠিন হবে বলে জানান তিনি।
মংলা ও খুলনার লঞ্চ ও ট্রলার মালিকরা জানান, পর্যটক না থাকায় ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। বিশেষ করে গত দেড় এক মাস ধরে অবস্থা বেশ নাজুক। বিদেশি ও দেশি পর্যটক বুকিং বাতিল করেছেন। কেউ আবার পিছিয়ে দিয়েছেন। অনেকের অগ্রিম পে করা আছে, সেই বুকিংও বাতিল হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৩৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫