ঢাকা, রবিবার, ৫ মাঘ ১৪৩১, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সুবহানের ফাঁসি

বাংলানিউজ টিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫
সুবহানের ফাঁসি ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাবনা জেলায় যুদ্ধাপরাধের হোতা সুবহানের বিরুদ্ধে আনা ৯টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের ৬টিই প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ এ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।



গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রসহ ৮ ধরনের ৯টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন পাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির ও কেন্দ্রীয় সূরা সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শান্তি কমিটির সম্পাদক ও পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান, রাজাকার-আলবদর-আলশামস-মুজাহিদ বাহিনীর নেতা আব্দুস সুবহান। পাবনায় যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার-আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতেও (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়)। তার হাতে নির্যাতিত-ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণও দাবি করেছিলেন প্রসিকিউশন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৩(২)(আই),  ৪(১), ৪(২)  এবং ২০ (২) ধারায় আনা এসব অভিযোগের মধ্যে ট্রাইব্যুনালের রায়ে ৬টি প্রমাণিত হয়েছে এবং বাকি ৩টি প্রমাণিত হয়নি।

প্রমাণিত ১, ২, ৩, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর- এ ৬টি অভিযোগের মধ্যে ১, ৪ ও ৬ নম্বর অর্থাৎ ৩টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ, ২ ও ৭ নম্বর অর্থাৎ ২টি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড এবং ৩ নম্বর অভিযোগে আরও ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে তাকে।

অন্যদিকে ৫, ৮ ও ৯ নম্বর- এ ৩টি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি বলে উল্লেখ করে এসব অভিযোগ থেকে সুবহানকে খালাস দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

বুধবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এ রায় ঘোষণা করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। বেলা এগারোটা ১৫ মিনিটে সুবহানের মামলার রায় ঘোষণা শুরু হয়ে বেলা এগারোটা ৫০ মিনিটে শেষ হয়।

সংক্ষিপ্ত ভূমিকা শেষে ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

এর আগে সকাল সাড়ে দশটার পরে ট্রাইব্যুনালে এসে বেলা এগারটা ৩ মিনিটে এজলাসকক্ষে আসন নেন বিচারপতিরা।

বেলা ১০টা ৫৮ মিনিটে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানা থেকে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয় সুবহানকে। সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটের দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে এনে সুবহানকে রাখা হয় হাজতখানায়। সকাল সকাল ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে কারাগার থেকে বের করে তাকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে রওনা হয় মাইক্রোবাসটি। তার পরনে ছিল সাদা রঙের পায়জামা-পাঞ্জাবি ও হাফহাতা সোয়েটার। তাকে চিন্তাযুক্ত দেখাচ্ছিল।

পাবনা শহরের পাথরতলা মহল্লার মৃত নঈমুদ্দিনের ছেলে আবুল বসর মোহাম্মদ আবদুস সুবহান মিয়া এলাকায় পরিচিত ‘মাওলানা সুবহান’ নামে। পাবনার সুজানগর উপজেলার মানিকহাটি ইউনিয়নের তৈলকুণ্ডি গ্রামে জন্ম নেওয়া সুবহান পাকিস্তান আমলে পাবনা জেলা জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির এবং দলটির কেন্দ্রীয় সূরা সদস্য ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে পাবনা জেলায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন আব্দুস সুবহান। পরে তিনি পাবনা জেলা শান্তি কমিটির সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ভাইস চেয়ারম্যান হন।

তার নেতৃত্বে পাবনা জেলার বিভিন্ন শান্তি কমিটি, রাজাকার আলবদর, আলশামস ও মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়।

রায়ে উল্লেখ রয়েছে, উর্দুতে কথা বলতে পারদর্শী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই কুখ্যাত জামায়াত নেতা পরিণত হয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন এক সহযোগীতে। স্বাধীনতা যুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সুবহানের ভূমিকা ছিল নীতিনির্ধারকের।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাবনার বিভিন্ন থানায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের নামের তালিকা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহ করতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের নেতৃত্ব দিয়ে এবং সঙ্গে থেকে হত্যা-গণহত্যা, অপহরণ, আটক নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে অংশ নিতেন নিজেও।

ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মিটিং করে স্বাধীনতাবিরোধী বক্তব্য দিতেন এবং পাকিস্তান সরকারের পক্ষে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে স্লোগানও দিতেন এই জামায়াত নেতা। পরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একাত্তরের ৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া সরকারের পতন দেখে গোলাম আযমের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
 
তিন গণহত্যার দায়ে ফাঁসি
ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে বের করে ১৯ জনকে হত্যা-গণহত্যা(১ নম্বর অভিযোগ), সাহাপুর গ্রামে হত্যা-গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৪ নম্বর অভিযোগ) এবং সুজানগর থানার কয়েকটি গ্রামে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও গণহত্যা চালানোর (৬ নম্বর অভিযোগ) দায়ে সুবহানকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।

প্রমাণিত ১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা পাবনার ঈশ্বরদী দখলে নিলে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রায় দুইশ’ নিরীহ-নিরস্ত্র লোক ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেন। সুবহান তার কয়েকজন সহযোগীসহ ১৭ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থক মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ১৮ এপ্রিল সকালে আওয়ামী লীগ সমর্থক মতলেব আহমেদ খান ও তার ছেলে মেধাবী স্কুলছাত্র নাজমুল হক খান হেলালকে মসজিদ থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী ঈশ্বরদী রেলওয়ে কয়লার ডিপো বধ্যভূমিতে নিয়ে যান। সেখানে ছুরি, চাকু ও তরবারি দিয়ে জবাই করে ওই তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।

এরপর ঈশ্বরদী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আশ্রয় নেওয়া আরও অন্তত ১৬ জনকে সুবহানের নির্দেশে রেলওয়ে কয়লার ডিপো ও আশেপাশে হত্যা করা হয়। অন্য শহীদরা হলেন আজিজুল গণি চৌধুরী, আজিজুল হক চৌধুরী, আজহার উদ্দিন চৌধুরী, তরুণ হোসেন, বাবর আলী সরদার, রফিক পাটোয়ারী, আব্দুল বারেক খলিফা, শামসুদ্দিন আহমেদ, খোরশেদ আনোয়ার, শফিকুল আনোয়ার মিলু, সাইফুল আনোয়ার মিলু, আমিনুল ইসলাম, আক্তার হোসেন খোকন, জসিম উদ্দিন তালুকদার ও মোকাররম হোসেন।

৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২ মে ফজরের নামাজের পর থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার খোদা বক্স খান, বিহারি ও পাকিস্তানি সেনারা বিকাল ৪টা পর‌্যন্ত ঈশ্বরদী থানার সাহাপুর গ্রামে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সুবহানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের চাঁদ আলী প্রামাণিক, আকতার প্রামাণিক, আনার প্রামাণিক, হামেজ উদ্দিন প্রামাণিক, রজব আলী বিশ্বাস, শামসুল হক, মোহাম্মদ আলী সরদারসহ অনেককে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় চাঁদ আলী প্রামাণিক, অধ্যক্ষ তৈয়ব হোসেন ও রহমান সরদারসহ ১০/১৫ জনের বাড়ি-ঘরের মালামাল লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১২ মে ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাবনার সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের মোমরাজপুর, কুড়িপাড়া, তারাবাড়িয়া, ফকিৎপুর, সাতবাড়িয়া, কন্দর্পপুর, সিন্দুরপুর, নিশ্চিন্তপুর, গুপিনপুর, হরিরামপুর, শ্যামনগর, নাড়ুহাটি, সিংহনগর, ভাটপাড়া ও গুপিনপুর গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, হিন্দু সম্প্রদায় ও স্বাধীনতাকামী নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের ওপর অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪শ’ লোককে অপহরণ, হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটান সুবহানের নেতৃত্বে আনুমানিক তিনশ’ পাকিস্তানি সেনা। সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা চলে গেলে শহীদদের মরদেহ তাদের স্বজনেরা ও স্থানীয় লোকজন নিজ নিজ বাড়ি এবং কন্দর্পপুর গ্রাম, কুড়িপাড়া গ্রাম ও সাতবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনের গণকবরে কবর দেন। এরপর সুবহান ও পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে সাতবাড়িয়া এলাকার হাজার হাজার নিরীহ জনতা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।

দুই গণহত্যার দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড
হত্যা-গণহত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের আরও দুই অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন সুবহান। ঈশ্বরদী থানার পাকশী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে (২ নম্বর অভিযোগ) এবং সদর থানার ভাড়ারা গ্রামে (৭ নম্বর অভিযোগ) এসব মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত আবদুস সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও বিহারিরা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাবনার ঈশ্বরদী থানার পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা, বাঘাইর ও গোপালপুরসহ আশেপাশের গ্রামে হামলা চালায়। তারা গোপালপুরের কোরবান আলীর বাড়িসহ গ্রামগুলোর বেশকিছু বাড়িতে লুটপাটসহ বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর বাঘইর গ্রামের আইজ উদ্দিনের স্ত্রী তুলু খাতুন, ছেলে ইসরাইল ও ভাই তাইজউদ্দিন, যুক্তিতলা গ্রামের জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, রুস্তম আলী, হারেছ উদ্দিন প্রামাণিক ও ইসমাইল হোসেনকে ধরে যুক্তিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নিয়ে এসে লাইন ধরে দাঁড় করায়। পাকিস্তানি সেনারা আটককৃতদের গুলি করলে জয়েনউদ্দিন মেম্বার, আহসান আলী ইঞ্জিনিয়ার, ইসমাইল হোসেন, হারেছউদ্দিন ও তাইজউদ্দিন মারা যান। রুস্তম আলী, ইসরাইল ও তুলু খাতুন গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তারা আরও অনেক লোকজনকে হত্যা করে।

৭ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২০ মে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত পাবনা সদর থানার ভাড়ারা গ্রামে হামলা করে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ ও নির্যাতন চালায় সুবহানের নেতৃত্বে প্রায় দুইশ’ পাকিস্তানি সেনা। এ সময় সুবহানের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ভাড়ারা গ্রামের কালি কমল পালকে তার নিজ বাড়িতে হত্যা এবং অন্য ১৮ জনকে অপহরণ করে ভাড়ারা স্কুল মাঠে মসজিদের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে সুবহানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা মজিদুল হককে গুলি করে হত্যা করে। এরপর অপহৃত অন্য ১৭ জনকে পাবনা শহরের নূরপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন শেষে ৬ জনকে ছেড়ে দেয়।

পরদিন ২১ মে বেলা ২টায় অপহৃত ১১ জনকে পাকিস্তানি সেনারা আটঘরিয়া থানার দেবোত্তর বাজারে যায়। সিরাজউদ্দিন শেখকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ১০ জনকে বাজারের পূর্বপাশে একটি বড় বাঁশবাগানের ভেতরে নিয়ে গুলি করে। এতে জব্বার শেখ, সিরাজ শেখ, নুরুল ইসলাম শেখ, হারুন শেখ, উটকেন শেখ ও তালেব শেখ শহীদ হন এবং মানিক খাঁ, রুস্তম শেখ, দেলবার শেখ ও আকবর শেখ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।

নির্যাতন-লুটপাটে আরও ৫ বছর
ঈশ্বরদী থানার অরণখোলা গ্রামের বেশ কয়েকজনকে অপহরণ, অবৈধ আটক ও নির্যাতন এবং তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের দায়ে (৩ নম্বর অভিযোগ) সুবহানকে দেওয়া হয়েছে আরও ৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ।  

৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের নিয়ে সুবহান ঈশ্বরদী থানার অরণখোলা গ্রামের জয়নুদ্দীন মণ্ডল ও তার ছেলে আলাউদ্দিন ও রিয়াজউদ্দিন, আছের আলী প্রামাণিক, জেহের আলী খাঁ, আব্দুর ছাত্তার বিশ্বাস এবং ময়েজউদ্দিনসহ হিন্দুপাড়ার হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, অবৈধ আটক ও নির্যাতন চালায়। তারা টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, তামা-কাসার বাসনপত্রসহ অন্যান্য মালামাল লুটপাট করে বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

১৬ মে বিকাল ৪টার দিকে সুবহান স্থানীয় বিহারিদের নিয়ে অরণখোলা গরুরহাট থেকে অরণখোলা গ্রামের জয়নুদ্দিন ও আনসার কমান্ডার আলাউদ্দিন মিয়াকে অপহরণ করে ঈশ্বরদীতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো ক্যাম্পে তিনদিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেন।

প্রমাণিত হয়নি যে তিন অভিযোগ
বাকি তিনটি অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি বলে উল্লেখ করে সেগুলো থেকে সুবহানকে খালাস দেওয়া হয়েছে। কুলনিয়া ও দোগাছি গ্রামের বেশ কয়েকজনকে হত্যা, অনেক বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ (৫ নম্বর অভিযোগ), অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক কলিমউদ্দিন খাঁসহ অন্য একজনকে হত্যা(৮ নম্বর অভিযোগ) এবং বেতবাড়িয়া ও রামনাথপুর গ্রামের চারজনকে হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, ১০/১২টি বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের (৯ নম্বর অভিযোগ) দায় থেকে মুক্ত হয়েছেন তিনি।   

প্রমাণিত না হওয়া ৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১১ মে বেলা ১১টার দিকে সুবহানের নেতৃত্বে প্রায় দুইশ’ পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পাবনা সদর থানার কুলনিয়া ও দোগাছি গ্রামে হামলা চালিয়ে অনেক বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা কুলনিয়া গ্রামের সমজুদ্দিন প্রামাণিক, তার স্ত্রী রাহাতন নেসা ও আমিনুদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা এবং দোগাছি গ্রামের গিরিপদ সাহা, বেনু সাহা, হরিপদ সাহা ও চাঁদ আলী প্রামাণিকসহ অন্য কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে।

৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের যেকোনো দিন সুবহানের নেতৃত্বে রাজাকাররা পাবনা সদর থানার চরতারাপুর টাটিপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক কলিমউদ্দিন খাঁসহ অপর একজন লোককে ধরে নিয়ে দুবলিয়া বাজার রাজাকার ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরদিন সকালে সুবহান ও রাজাকাররা কলিমউদ্দিন ও আটককৃত লোকটিকে সদর থানার (বর্তমান আতাইকুলা থানা) কুচিয়ামাড়া গ্রামে রাধা গোবিন্দ কালিমন্দিরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

৯ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সুবহানের নেতৃত্বে খোদাবক্স খান ও ইসহাক রাজাকারসহ স্থানীয় ৫০/৬০ জন রাজাকার হামলা চালিয়ে ঈশ্বরদীর বেতবাড়িয়া গ্রামের সফিউদ্দিন প্রামাণিক, খবিরউদ্দিন সরদার ও তোফাজ্জল বিশ্বাস এবং রামনাথপুর গ্রামের সাবেদ আলী প্রামাণিকসহ ১০/১২টি বাড়ি-ঘরে লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তারা বেতবাড়িয়া গ্রামের সফিউদ্দিন এবং রামনাথপুর গ্রামের সাবেদ আলীর ছেলে ওসমান, ভাদু ও বয়নাকে ধরে নিয়ে ঈশ্বরদীর সিএসডি গুদামের পাশে শান্তি কমিটির অফিসে নিয়ে নির্যাতন চালায়। তিনদিন পর রাজাকাররা তাদেরকে ঈশ্বরদী ডাকবাংলো পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। তাদের মরদেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নাই।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫আপডেট : ১৯৩৬ ঘণ্টা

** সুবহানের ফাঁসির রায়ে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সন্তোষ
** ট্রাইব্যুনালে সুবহান ছিলেন নির্লিপ্ত
** সুবহানের ফাঁসির রায়কে স্বাগত জানিয়ে সিলেট আ’লীগের মিছিল
** উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে
** সুবহানের ফাঁসির আদেশে ড. আনোয়ার হোসেনের সন্তোষ
** সুবহানের ফাঁসির আদেশে তুরিন আফরোজের সন্তোষ
** এজলাসে বিচারকরা, কাঠগড়ায় সুবহান
** ট্রাইব্যুনালে বিচারকরা
** ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় সুবহান
** সুবহানের যুদ্ধাপরাধের রায়ের অপেক্ষা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।