ঢাকা: ‘‘স্বপ্না চোখ খোলো! কথা বলো স্বপ্না!’’ এভাবে মৃদু স্বরে সকাল থেকেই স্বপ্নাকে ডাকছেন তার স্বামী রাফিউর রহমান।
পৃথিবীতে বিস্ময়কর কত ঘটনাই তো ঘটে! কখনো কখনো মৃতপ্রায় মানুষও জেগে ওঠে।
চিকিৎসকরাও কখনো মৃদু নাড়া দিচ্ছেন স্বপ্নাকে। ডাকছেন! কিন্তু কোনো ডাকেই সাড়া দিচ্ছেন না স্বপ্না। আধ খোলা চোখে তাকিয়ে রয়েছেন শুধু।
স্বপ্নার নাকে রাইলস টিউব দেওয়া রয়েছে। মুখেও লাগানো রয়েছে এনডোট্রাকিয়াল টিউব।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গত চারদিন ধরে এভাবেই অচেতন শরীর নিয়ে পড়ে রয়েছেন স্বপ্না।
তাকে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অনুষদের ডিন, অধ্যাপক থেকে সহপাঠী, সবাই ছুটে আসছেন হাসপাতালে। সদা হাস্যেজ্জল ও প্রাণবন্ত এই শিক্ষার্থীর এমন চুপচাপ থাকা কেউ মেনে নিতে পারছেন না।
ধীরে ধীরে স্বপ্নার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এরই মধ্যে অকার্যকর হয়ে গেছে তার পাকস্থলি।
স্বপ্নার সব স্বপ্নই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে ক্ষণিকের ভুলে। ব্যথার ওষুধের মাত্রারিক্ত প্রতিক্রিয়ায় আজ মৃত্যু পথযাত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্বপ্না খাতুন।
নাটোরের বনপাড়া উপজেলার ঢুলিয়া গ্রামের কৃষক সবের আলী ও মালেকা বেগমের মেয়ে স্বপ্না। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার ছোট। দুই ভাই তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক। বরাইগ্রাম উপজেলা পরিষদের ষাটমুদ্রাক্ষরিক রাফিউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় স্বপ্নার।
২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিয়ের পর স্বপ্না ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তি হন।
প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফলে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন স্বপ্না। তার পর থেকেই মেধাবী স্বপ্নাকে ঘিরে সম্ভাবনার আলো দেখতে থাকেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে ফিরে যান জাহানারা ইমাম হলে।
ব্যাথা কমাতে বেশ কয়েকটি প্যারাসিটামল সেবন করে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রচণ্ড বমি, জ্বর ও চোখে ব্যাথা নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয় সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সহকারী অধ্যাপক ডা. ইয়াসনিম খানম বাংলানিউজকে জানান, স্বপ্নাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে গত চার দিনেও তার জ্ঞান ফেরেনি।
বর্তমানে অধ্যাপক ডা. রেজাউল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে স্বপ্নার। বাংলানিউজকে তিনি জানান, প্রাথমিক পরীক্ষার পর মনে হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ব্যথার ওষুধ সেবনে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় লিভার অকেজো হয়ে পড়েছে স্বপ্নার।
রেজাউল হক জানান, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া তার জীবন বাঁচানোই কঠিন।
স্বপ্নার স্বামী রাফিউর রহমান বাংলানিউজকে জানান, ১৪ ফ্রেরুয়ারি স্বপ্না তাকে ফোন করেন বলেন, প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। এটাই ছিল তার সঙ্গে স্বপ্নার শেষ কথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, চোখের সামনে একজন মেধাবী শিক্ষার্থী এভাবে মৃত্যুর অতল গহব্বরে তলিয়ে যাবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
স্বপ্নার সহপাঠী আমিনুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রিয় বন্ধুকে বাঁচাতে আমরা অনেকের কাছেই ছুটে যাচ্ছি। ফেসবুকে ইভেন্ট পেজ খুলে আমরা সবার কাছে সাহায্য চাইছি।
রেদওয়ান আল রুম্মান বাংলানিউজকে বলেন, স্বপ্না আমাদের মাঝে থাকবে না- তা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। স্বপ্নাকে বাঁচাতে আমরা বইমেলা, যমুনা ফিউচার পার্ক ও বসু্ন্ধরা সিটিতে হৃদয়বানদের সাহায্য চাইছি।
শাহারিয়ার আবুল খায়ের নেহাল বাংলানিউজকে বলেন, কেবল লেখাপড়াতেই নয়, হ্যান্ডবলেও হল চ্যাম্পিয়ন ছিল স্বপ্না। তার জন্যে গত চারদিনেই লাখ খানেক টাকার ওষুধ কেনা হয়েছে। যে করেই হোক মৃত্যুর দুয়ার থেকে প্রিয় বন্ধুকে ফিরিয়ে আনবো আমাদের মাঝে।
তবে চিকিৎসকরা বলেছেন, স্বপ্নার অবস্থার অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেবল সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই ফিরে আসতে পারেন স্বপ্না।
বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫