ঢাকা, সোমবার, ৬ মাঘ ১৪৩১, ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

গতি কম তাই যাত্রীও কম

নাজিম উদ্দিন খান লিয়ন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫
গতি কম তাই যাত্রীও কম ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ধীরগতিতে চলাচল করায় যাত্রী হারাচ্ছে বাদামতলী থেকে গাবতলী নৌ-পথে ‍চালু হওয়া ওয়াটার বাস সার্ভিস। ৪০/৪৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে দেড় দু’ঘণ্টা লেগে যায় বলে ওয়াটার বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন যাত্রীরা।

অন্যদিকে পূর্ণগতিতে ওয়াটার বাস চালালে নদীর পাড় ধসে যায় বলে জানিয়েছেন চালকরা।

এছাড়াও সময়মতো বাস না পাওয়া, পর্যাপ্ত বাস না থাকা এবং সুবিধাজনক ল্যান্ডিং স্টেশনের অভাবের অভিযোগ রয়েছে যাত্রীদের। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ সার্ভিসের নানাবিধ অভিযোগও তুলেছেন তারা।

২০১০ সাল থেকে রাজধানীর যানজট নিরসনে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) উদ্যোগে বাদামতলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু করা হয়। কিন্তু প্রথম থেকেই নানা রকম অব্যবস্থাপনার কারণে যাত্রীরা সার্ভিসটির সুবিধা ভোগ নিতে পারছেন না।

ওয়াটার বাস সার্ভিসের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিআইডব্লিউটিসি ঢাকা, বাদামতলী ঘাটের এজিএম (কমার্শিয়াল) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।

তিনি জানান, রাজধানীবাসীর চলাচলকে সহজতর করতে ২০১০ সালে ওয়াটার বাস সার্ভিস চালু হয়। এমএল বুড়িগঙ্গা ও এমএল তুরাগ নামে দুটি ওয়াটার বাস দিয়ে এই সার্ভিস চালু হলেও বিভিন্ন সময় এর বহরে নতুন বাস যোগ হয়। বর্তমানে ১২টি ওয়াটার বাস চালু রয়েছে। এর মধ্যে সাতটি বাস বাদামতলী-সোয়ারিঘাট-খোলামোড়া-গাবতলী রুটে, চারটি নারায়ণগঞ্জ-কাচঁপুর-টঙ্গী রুটে আর একটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলিতে চলাচল করছে। বাদামতলীর সাতটি ওয়াটার বাস প্রতিদিন সাতটি ট্রিপ দিচ্ছে বলেও তিনি জানান।

খালেদ নেওয়াজ আরও জানান, ওয়াটার বাস সার্ভিসের চারটি ল্যান্ডিং স্টেশনে একটি থেকে অন্যটি পর্যন্ত ভাড়া সর্বোচ্চ ৪০ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ১০ টাকা রাখা হয়। সার্ভিসটি চালুর শুরুর দিকে অনেক যাত্রী ছিল। কিন্তু এখন আর সেই পরিমাণ যাত্রী আসছে না। বাসগুলোর চলাচলে ধীর গতি এবং ঘাটে যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার অভাবকেই তিনি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

ধীরগতিতে চলার কারণ জানতে চাইলে খালেদ নেওয়াজ বলেন, ওয়াটার বাস সাধারণত যে গতিতে চলে সে গতিতে চালালে নদীর দুপাশের পাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই চালক চাইলেও পূর্ণ গতিতে চালাতে পারছেন না। আর এ কারণেই ৪০-৫০ মিনিটের রাস্তা দেড় ঘণ্টায় যেতে হয়।

অন্যদিকে যাত্রীদের আরও অসুবিধার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বাদামতলী ঘাটে কোনো যাত্রী ছাউনি নেই। আলাদা জেটিও নেই। জেটি না থাকায় যেখানে সেখানে বাসগুলো ভেড়াতে হয়। এছাড়া পল্টুন না থাকায় যাত্রীদের অনেক পথ ঘুরে ওয়াটার বাসে উঠতে হচ্ছে।

খালেদ নেওয়াজ বলেন, বাদামতলী ঘাটে পল্টুন ও যাত্রী ছাউনি করে দেওয়ার কথা থাকলেও আজও সেটা সম্ভব হয়নি।
অব্যবস্থাপনা দূর না করলে এ সার্ভিসকে বেগবান করা যাবে না। তাই সার্ভিসকে আরও বেগবাগ করতে বিআইডব্লিউটিসি এবং বিআইডব্লিউটিএ’র (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষ) মধ্যে সমন্বয় খুবই জরুরি।

বাদামতলী ঘাটে কবে নাগাদ পল্টুন ও যাত্রী ছাউনি দেওয়া হবে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন বাংলানিউজকে জানান, এটি প্রকল্পের অধীন রয়েছে। সুতরাং চলতি অর্থবছরেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

ওয়াটার বাস সার্ভিস-৫ এর চালক মোহাম্মদ সুমন বাংলানিউজকে বলেন, যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম। বাসে ৪৬ জনের আসন থাকলেও প্রতিদিন ১০-১২ জন যাত্রী হয়। কোনোদিন ৫/৬ জন যাত্রী নিয়েও বাস ছাড়ি। কিন্তু এগুলো দেখার কেউ নেই। একটু চিন্তা করে ব্যবস্থা নিলেই এ অবস্থার অবসান করা যায়।

কয়টা থেকে বাস ছাড়া হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ট্রিপ দেওয়া হয়।

ওয়াটার বাস-৫ এর ইঞ্জিন চালক মোহাম্মদ সেকেন্দার মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমি মনে করি, এটা সরকারের পুরাপুরি লোকসান প্রকল্প। কারণ, আধা কাম কইরা থুইলে লাভ আইবো কইতথ্যাইকা?

তিনি বলেন, শুধু যাত্রীদের সুযোগ সুবিধার সমস্যা না, বাসগুলোর ইঞ্জিনেরও সমস্যা আছে। কিছুদিন পর পরই সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় যাত্রী নিয়ে রাস্তায়ও বন্ধ হয়ে যায় বাসগুলো। এত সমস্যা থাকলে যাত্রী আসবে কেন?

কথা হয় ওয়াটার বাসের গাবতলীর যাত্রী রানী মণ্ডলের সঙ্গে। ওয়াটার বাসে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে হরতাল-অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর হতো। এখন তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। এখন চলন্ত গাড়িতে বোমা মারে। তাই নিরাপত্তার জন্য এই পথে যাতায়াত করেন।

সব সময় এই বাসে যাওয়া-আসা করা হয় কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেতে তো চাই। কিন্তু অনেক সময় লাগে। তাছাড়া ভাড়াও অনেক বেশি।

গাবতলীর আরেক যাত্রী মোহাম্মদ জুয়েল বাংলানিউজকে বলেন, ব্যবসার কারণে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৪-৫ বার তার গাবতলী যেতে হয়। দূরের রাস্তা একটু আরামে যেতে চান। আরামের জন্য এই বাসে যেতে চান। কিন্তু খরচ আর সময়টাও একটা বিষয়। তাই সব সময় যেতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন,  ঘাট থেকে একটু সামনেই বাবুবাজার। সেখান থেকে প্রতি ১০ মিনিট পর পর গাবতলীর উদ্দেশে বাস ছেড়ে যাচ্ছে। আবার ভাড়াও কম। আর এই ওয়াটার বাসে বসে অপেক্ষা করতে হয়। বাস ছাড়ার জন্য চালকের সঙ্গে চেচামেচি করতে হয়। আবার অনেক সময় নিজের কাছেও খারাপ লাগে। যখন দেখি যাত্রী নাই, কিন্তু তারপরও যাত্রীদের চেচামেচিতে চালক খালি বাস নিয়েই ছেড়ে দিচ্ছেন।   

জুয়েল বলেন, সরকার যদি এদিকে একটু খেয়াল করে এই সার্ভিস ভালো করতে পারতো। এই রকম মরা-মরা হয়ে থাকতো না সার্ভিসটি।
 
পূর্ণগতিতে ওয়াটার বাস চালালে নদীর পাড় ধসে যাবে এ অজুহাত ঠিক নয় বলেও দাবি করেন অনেক যাত্রী।
  
গাবতলী টার্মিনালের সুপারিনটেন্ডেন্ট মাহমুদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিটি ট্রিপেই হাতে গোনা যাত্রী থাকে। তাই লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে না। লাভের মুখ দেখতে চাইলে অবশ্যই যাত্রীদের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি প্রচারণার কাজটাও করতে হবে। তাহলেই এটা সফলতার মুখ দেখবে। প্রতি ট্রিপে ৮৬ লিটার তেল লাগে। আর যাত্রী আছে নামমাত্র। ট্রিপ দেওয়ার পর তেলের টাকাই ওঠে না। আর অন্যান্য খরচতো বাদই দিলাম।
 
ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে ২০১০ সালে বিআইডব্লিটিসি উদ্যোগে চালু করা হয় ওয়াটার বাস সার্ভিস। কিন্তু যাত্রী সংকট ও নানা ধরনের অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে সার্ভিসটি। প্রথম পর্যায়ে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে এমএল বুড়িগঙ্গা ও এমএল তুরাগ নামে দুটি বাস সার্ভিস দিয়ে এর কার্যক্রম শুরু করেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান।

প্রতিটি ওয়াটার বাসে আসন ছিল ৩৫টি। প্রথম থেকেই লোকসান গুণতে থাকলেও বিআইডব্লিউটিসি ‍আবারও ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে সার্ভিসটিতে আরও চারটি বাস যোগ করে। ‍ সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর পাঁচ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ব্যয়ে আরো ছয়টি বাস চালু করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।