শেরপুর (বগুড়া): দিনের পর আসে মাস। মাসের পর আসে বছর।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার ও আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্রযুবা আজকের বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেন।
সেই ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য সময়ের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে উঠেছে। এসব শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে একটি দিনের জন্য হলেও বাঙালি জাতি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুভার্গ্যের বিষয় হলো স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৩টি বছর পেরিয়ে গেলেও, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার প্রায় ২৩২টির সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১০টি ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানেই সেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি। অথচ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করেন।
ফলে সরকারিভাবে প্রতিবছর দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আদৌ কতটুকু পালন হচ্ছে তা এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। তবে শহর এলাকায় কিছু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হওয়ায় দিবসটি দিন দিন শহর কেন্দ্রিক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
কিন্তু সিংহভাগ মানুষের বসবাস গ্রামাঞ্চলে হয়ে থাকলেও সেখানে আজও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা আজ ভাষা শহীদদের নাম পর্যন্ত ভুলে যেতে বসেছেন।
তবে এ নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছেন আগামীর ভবিষ্যৎ ও জাতীর কর্ণধার বলে বিবেচিত শিশু শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার না থাকায় এসব শিশুরা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী সেই শহীদদের নাম ও আত্মত্যাগের কৃতকর্ম কেবল বইপুস্তকে যতটুকু পাচ্ছে তাই বুলি আওড়িয়ে মুখস্ত করে চলছে। কিন্তু এ বিষয়ে সুযোগ না থাকায় তাদের কোন বাস্তব ধ্যান ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে না।
আর এভাবে মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে একটি জাতীর ইতিহাস ঐতিহ্য কতদিন সঠিকভাবে ধরে বা মনে রাখা সম্ভব -এই প্রশ্ন অভিভাবকদের মত সাধারণ মানুষেরও।
বুধবার (১৮ফেব্রুয়ারি) উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাষা শহীদদের নিয়ে কথা হলে এসব তথ্য ওঠে আসে।
উপজেলা মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এ উপজেলায় ৩৭টি দালিখ ও এবতেদায়ি, ২টি আলিম, ২টি ফাযিল ও ১টি কামিল মাদ্রাসা রয়েছে। এরমধ্যে শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। অপরদিকে সরকারি স্বীকৃতপ্রাপ্ত মাধ্যমিক ও কারিগরি বিদ্যালয় ৫০টি এবং ৩টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৮-৯টি প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে।
এদিকে ১৩৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। যার একটিতেও শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আজ পর্যন্ত কোন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে ওঠেনি।
এরমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০-৩৫হাজার, দাখিল, আলিম, ফাযিল, কামিল ও এবতেদায়ি মাদ্রাসায় প্রায় ১৯হাজার এবং মাধ্যমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ২৪হাজার ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করেন।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা বাংলানিউজকে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার আছে কী নাই জানতে চেয়ে প্রায় বছরখানেক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি প্রতিবেদন চাওয়া হয়। সে অনুযায়ী প্রতিবেদন পাঠানোও হয়।
কিন্তু অদ্যাবধি পর্যন্ত এর কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে তারা এখনও অন্ধাকারেই রয়েছেন। ফলে আগে যেমনভাবে গুরুত্ব সহকারে জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয়েছে। এবারও সেভাবেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে। তবে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ না থাকায় শিশুদের মৌখিক কলা কৌশলের মাধ্যমে বরাবরই এ ধরনের জাতীয় দিবস পালন করতে হচ্ছে। যা এসব কোমলমতি শিশুদের জন্য মোটেও শুখকর নয় বলে এই কর্মকর্তা স্বীকার করেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, দেশের প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এতদিনেও তা গড়ে ওঠেনি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি জাতীয় দিবসে শহীদদের প্রতি সরাসরি শ্রদ্ধা জানাতে পারে না।
এই শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে এখনও পর্যন্ত সরকারি কোন নির্দেশনা আসেনি। এছাড়া এ জন্য কোন সরকারি বরাদ্দও নেই। তাই নিজ উদ্যোগে যারা শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে -এরকম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৯-১০টির মত হবে। তবে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে সরকারি কোন নির্দেশনা আসলে তা যথাযথভাবে কার্যকর করা হবে বলে এই শিক্ষা কর্মকর্তা দাবি করেন।
এদিকে ২০১২সালে ২০অক্টোবর শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসায় একটি আধুনিক মানের শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সেখানে প্রতিটি জাতীয় দিবসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র জিহাদুল ইসলাম, আব্দুল হালিম ও আবু সালেহে বাংলানিউজকে জানান, তারা আগে কেবল বইপুস্তুকেই শহীদদের আত্মত্যাগের কথা পড়তেন। তাদের ব্যাপারে শিক্ষকদের কাছে জানতেন। গ্রামে থাকার কারণে এর বাইরে তাদের আর কিছুই করার থাকতো না। কিন্তু এখন সেই সমস্যা নেই। বন্ধু-বান্ধব সহপাঠিরা মিলে প্রতিবারই শহীদদের প্রতি ফুলেল জানান তারা।
শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, অত্র প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও বগুড়া -৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের এমপি হাবিবর রহমান মহোদয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাদ্রাসার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৪লাখ ব্যয়ে আধুনিক মানের এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
শহিদুল ইসলাম, শাহিন আকতার, শাহিনুর রহমান, আবু রায়হানসহ একাধিক অভিভাবক বাংলানিউজকে জানান, তাদের শিশু সন্তানরা যে সব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেন সেখানে কোন শহীদ মিনার নেই। ফলে তারা অন্য সময়ের মত এবারেও ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবে না। তাই বিগত সময়ে বিদ্যালয়ে গিয়ে যা করেছে এবারও হয়তো ওরা তাই করবে বলে তারা জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ.কে.এম সরোয়ার জাহান বাংলানিউজকে জানান, এ ধরনের কোন তথ্য তার নজরে আসেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরাও বিষয়টি কখনও তাকে জানায় নি। এরপরও উচিত ছিল প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনার নির্মাণ করা। কিন্তু এতদিনেও তা হয়নি শুনে তিনি হতবাক। তবে আগামি দিনে তিনি বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানাবেন বলে এই কর্মকর্তা জানান।
বাংলাদেশ সময়: ০১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৫