ঢাকা: বরাদ্দ নেই, প্রস্তাবের চিঠি দেড় বছর ধরে ঝুলছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। ফলে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে সহসাই স্বীকৃতি ও ঘোষিত বেতন স্কেল পাচ্ছেন না গ্রাম পুলিশ সদস্যরা!
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি ও বেতন স্কেল দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে, গ্রাম পুলিশ নিয়োগ ও তাদের কর্মপরিধি নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালে জারি করা গেজেট সংশোধনের অজুহাতে চার বছর ধরে ঝুলে আছে।
সাত দফা দাবি আদায়ে বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন গ্রাম পুলিশ সদস্যরা।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেতন স্কেল, রেশন, অবসর, ঝুঁকিভাতা ও গ্রাচ্যুইটি, প্রশিক্ষণ, কল্যাণ তহবিল গঠন ও বিধিমালা তৈরি।
ঘোষিত স্কেল কার্যকর না করায় সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী আবারও কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
সংগঠন সূত্র জানায়, গ্রাম পুলিশদের প্রতি বছর সরকারি অংশ থেকে সম্মানী (বেতন) দেওয়া হয় ৬১ কোটি ৪২ লাখ ৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে দফাদাররা প্রতি মাসে জনপ্রতি পান এক হাজার তিনশ’ টাকা ও মহল্লাদাররা এক হাজার একশ’ টাকা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রত্যেক দফাদার সরকারি অংশ থেকে দুই হাজার পাঁচশ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদ অংশ থেকে এক হাজার পাঁচশ’ টাকা পাবেন। মহল্লাদার সরকারি অংশ থেকে দুই হাজার একশ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এক হাজার চারশ’ টাকা পাবেন। দফাদার ও মহল্লাদারকে বেতন দিতে বছরে ১৯৪ কোটি ৭২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা লাগবে।
এর মধ্যে সরকারি অংশ ১১৭ কোটি ৩৮ লাখ ৩২ হাজার ৮শ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদের অংশ হবে ৭৭ কোটি ৩৪ লাখ ১৩ হাজার ২শ’ টাকা।
বছরে সরকারের অতিরিক্ত ৫৫ কোটি ৯৪ লাখ ৯০ হাজার ৪শ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদের ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৭ হাজার ২শ’ টাকার প্রয়োজন হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সংসদে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হাজী সেলিম গ্রাম পুলিশদের চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর সমান স্কেল দেওয়ার সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়ন বিষয়ে জানতে চান।
উত্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
এক্ষেত্রে বাজেটে কোনো বরাদ্দ না রাখায় প্রস্তাবটি অনুমোদন করতে পারছে না বলে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বলে সংগঠনটির নেতারা দাবি করেন।
স্থানীয় সরকার বিভাগ ‘স্থানীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ গ্রাম পুলিশ বাহিনী (দফাদার ও মহল্লাদার) বিধিমালা, ২০১৩’ প্রণয়ন করলেও দুই বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
সূত্র জানায়, সারা দেশে চার হাজার ৫৪৮টি ইউনিয়নে একজন করে দফাদার ও নয়জন করে মহল্লাদারসহ মোট ৪৬ হাজার ৮৭০ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য রয়েছেন।
গ্রাম পুলিশরা প্রায় ৭০ ধরনের কাজ করে থাকলেও তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদের কাজের মধ্যে রয়েছে, কর আদায়, জন্ম-মৃত্যু, বিধবা-বয়স্ক ভাতার তালিকা তৈরি, ভিজিডি-ভিজিএফ বণ্টন, ইউনিয়ন পরিষদের নোটিশ জারি, পুলিশের সঙ্গে আসামি আটক, নির্বাচনী দায়িত্ব পালন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিঠি বিলি, মহল্লা, রেললাইন পাহারা ও থানায় হাজিরা দেওয়া।
সূত্র আরও জানায়, দফাদাররা জনপ্রতি সরকার থেকে এক হাজার তিনশ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আটশ’ টাকাসহ মোট দুই হাজার একশ’ টাকা বেতন পান।
মহল্লাদাররা সরকার থেকে এক হাজার একশ’ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আটশ’ টাকাসহ মোট এক হাজার নয়শ’ টাকা বেতন পান।
তাও আবার তিন থেকে ছয় মাস পর পর বেতন দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও তারা সাত থেকে আট বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদের অংশ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি অংশের বেতন ইস্যুতে সচিবালয়, এজি অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ না দিলে দফাদার, মহল্লাদাররা বেতন পান না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার নয়টি ইউনিয়নে ১৯৯৩ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের বেতন (সম্মানী) বাকি রয়েছে।
বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের মানিকগঞ্জ জেলা সভাপতি ও দৌলপুর উপজেলার চর কাড়ালি ইউনিয়ন দফাদার মো. ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে এর সত্যতা স্বীকার করেন।
নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ঘোষবাগ ইউনিয়নের মহল্লাদারদের বেতনের ইউনিয়ন পরিষদের অংশ গত পাঁচ বছর ধরে বাকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন মহল্লাদার মো. শরীফুল ইসলাম।
শরীফুল বাংলানিউজকে বলেন, কামলা দিলেও দিনে সাড়ে তিনশ’ টাকা পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় সব কাজ করেও দিনে বেতন পাই মাত্র ৬৩ টাকা। ১৭ বছর চাকরি করেও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছি।
একই উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দফাদার মো. রফিক উল্যাহ বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাগি আসামি থেকে শুরু করে সব ধরনের অপরাধীকে ধরতে পুলিশকে সহায়তা করি।
রফিক বলেন, সরকার সব সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করেছে। কোনো কিছু নয়, অন্তত বেঁচে থাকতে যেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর স্বীকৃতি নিয়ে মরতে পাই, এটাই শুধু চাই।
বাংলাদেশ গ্রাম পুলিশ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক বাংলানিউজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট না থাকার অজুহাতে প্রস্তাব অনুমোদন করা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, বর্তমান বাজেটে গ্রাম পুলিশের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। গ্রাম পুলিশরা বর্তমান বাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।
উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা ও প্রযুক্তির ছোঁয়া পেলে গ্রাম পুলিশও একটি আর্দশ বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে মন্তব্য করে মোজাম্মেল বলেন, ঘোষণা না এলে বাধ্য হবো আন্দোলনে যেতে।
গ্রাম পুলিশদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমান স্কেল ঘোষণা অবিলম্বে কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৫