ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বিভীষিকাময় ৩ মার্চ

টি. এম. মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৫
বিভীষিকাময় ৩ মার্চ

বগুড়া: আজ বিভীষিকাময় ৩ মার্চ। ২০১৩ সালের এই দিনে বগুড়ায় ভাঙচুর, সংযোগ, সংঘর্ষ ও লুটপাট সবকিছুই হয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় ছাড়া এতোবড় রকমের বেদনা বিধূর ঘটনা জাতি আর কোনদিন দেখেনি বগুড়ায়।

অপরাধের ধরণ দেখে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠেছে, রাষ্ট্রের বিরোধীতা, নাকি দেশ থেকে বগুড়াকে পৃথক করতেই এই ধ্বংসযজ্ঞ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও বেশ খানিকটা কঠোর হতে হয়েছিল।

২০১৩ সালের ৩ মার্চ (রোববার) ভোর র‍াত ৩টার পরই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে জামায়াত নেতা মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ভক্তরা। শুরু হয় নানা রকম ধ্বসাত্মক কর্মকান্ড। মোবাইল ফোনে ম্যাজেস, মসজিদে মাইকিং করে জামায়াত নেতা মওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে বলে গুজব রচনা করে সাঈদী সমর্থকসহ জামায়াত-শিবির। প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উত্তেজিত করে তোলে শিশু, কিশোর ও নারীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে।

বুঝে না বুঝে, ইচ্ছে করে বগুড়া জেলা শহরসহ শাজাহানপুর, নন্দীগ্রাম, দুপচাঁচিয়া, শিবগঞ্জ ও গাবতলী উপজেলা শহরের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ। ধ্বসাত্মক কর্মকান্ড ও হিস্রতার সে কি ভয়াবহ রূপ, এ যেন আরেকটি স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ।

বাইরে বের হতেই চোখে পড়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে সড়ক ও এর আশপাশের বিভিন্ন ধরনের দোকান, অফিসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসযজ্ঞ। ইট, পাথর, গাছের গুড়ি, সিমেন্টের খুটিসহ নানা ধরনের জিনিস দিয়ে অচল করে দেওয়া হয় বগুড়াকে। এরই মাঝে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মরদেহ ও পড়ে থাকা রক্ত আতকে তোলে মানুষকে। এ দৃশ্য দেখে যে কোনো বিবেকবান মানুষের চোখে বান বয়ে যায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলপথ, পুলিশ ফাঁড়ি ও থানা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের এমন কোনো দফতর নেই যেখানে  আঘাত বা হামলা করেনি আন্দোলনরত সাঈদী সমর্থকরা। হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি সাংবাদিক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, ইউএনও, গণমাধ্যম অফিসসহ সরকারের উন্নয়নমূলক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ও এদের যানবাহন।

ওইদিন ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকার সম্পদ। শুধু তাই নয়, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ল‍াখ লাখ টাকা লুট করেছে এক শ্রেণির মানুষ। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে ৩ নারী ও শিশুসহ ১৩ জন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে থেকে ফিরে এলেও গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করে কমপক্ষে ১০ পুলিশ সদস্য। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে শাজাহানপুর থানাকে রক্ষা করে।

ওইদিন বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয়, আক্রান্ত থানার পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) রিয়াজ উদ্দিন, মাহমুদুল আলম, আমিনুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। মোবাইল ফোন ধরতেই নানা কথা বলেন তারা। বলেন তারা, ভাই আমার জন্য দোওয়া করবেন। জানিনা আজ কি হবে। কোনো ধরনের ভূলত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন, এর বেশি কিছু আর বলার সময় নেই ভাই। বাইরে ঘেরাও করে রেখেছে সাঈদী সমর্থকরা।     

জেলা পুলিশের হিসেবে বগুড়া সদর থানায় এক হাজার জনের নাম উল্লেখ করে পৃথক ১২ মামলায় কমপক্ষে ৬ হাজার জন,  দুপচাচিয়া থানায় ১১ টি মামলায় দেড় হাজার জনের নাম উল্লেখ করে প্রায় দশ হাজার, শাজাহানপুরে ৯ মামলায় ৭২৩ জনের নাম উল্লেখ পূর্বক কমপক্ষে ২২ হাজার, নন্দীগ্রামে ৪ মামলায় কমপক্ষে ৭৫০ জনের নাম উল্লেখ করে প্রায় ১৫ হাজার, শিবগঞ্জ থানায় ৩ মামলায় ১১০ জনের নাম উল্লেখ করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার এবং গাবতলী থানায় ৯ মামলায় কারো নাম উল্লেখ ছাড়াই কমপক্ষে অজ্ঞাতনামা আড়াই হাজার ব্যক্তির নামে মামলা নথিভূক্ত হয়। প্রত্যেকটি থানায় একটি করে মামলার বাদি পুলিশ, বাকিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের দাবি, ৩ মার্চে হামলাকারী কখনও দেশের পক্ষের মানুষ হতে পারেনা। তারা দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু। সেদিন বে-আইনী জনতায় দলবদ্ধ হয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও গুলিবর্ষণ করে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করে গোট দেশ থেকে তারা বগুড়াকে পৃথক করার বে-আইনী ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু সাংবাদিক ও বগুড়াবাসীর সচেতন মানুষসহ ৠাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশ কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বগুড়াকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিলো।

বগুড়া পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক পিপিএম বাংলানিউজকে জানান, ২০১৩ সালের ৩ মার্চের সেই ভয়াবহ দিনের শুরুতেই পরিস্থিতি অনুমান করে ত‍ৎকালীন জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদকে বলে উল্লেখিত থানা এলাকাগুলোতে ১৪৪ ধারা জারী করার অনুরোধ করলে জেলা প্রশাসক অনুরোধে সারা দিয়ে সবগুলো স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করেন। কিন্তু তারপরও এতোসব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে জামায়াত-শিবিরসহ সাঈদী সমর্থকরা।

পুলিশ সুপার আরো জানান, এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে সব মিলিয়ে ৫৬ টি মামলা হয় থানায়। যাতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫ টি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল এবং বাকি ৫১ টি মামলায় ৮৪৩ জনকে গ্রেফতার পূর্বক ৩১২০ জনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশিট দাখিল করা করা হয়েছে।      

এদিকে, রক্তঝরা ৩ মার্চকে গণহত্যা দিবস উল্লেখ করে জামায়াত ইসলামীর প্রচার বিভাগ থেকে পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, সেদিন তৌহিদী জনতার স্বত‍ঃস্ফুর্ত আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা ছিলনা। বরং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরপরাধ ১৩ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।