ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি): বিজ্ঞান-লেখক ও ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর থেকে ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় ভ্রাম্যমাণ টং-দোকানগুলো।
তবে টিএসসির দোকানগুলো বন্ধ থাকলেও যথারীতি খোলা রয়েছে, হামলার স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটসংলগ্ন দোকানগুলো।
বুধবার (০৪ মার্চ) সরেজমিন দেখা যায়, টিএসসির কোনো দোকান খোলা নেই। অথচ সোহরাওয়ার্দীর গেটের অন্তত পাঁচটি টং-দোকান ও দুটি ফুচকার দোকান খোলা রয়েছে।
এদিকে, টিএসসির টং-দোকানগুলো বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আড্ডার মূল জায়গা হচ্ছে, টিএসসি।
এছাড়া ৩০টিরও বেশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে টিএসসিতে। যারা হাল্কা নাস্তাসহ আড্ডার জন্য পুরোপুরি ওই টং-দোকানগুলোর ওপর নির্ভরশীল।
এ বিষয়ে অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘স্ট্যাটাস’ দিয়েছেন।
মাস্টারদা সুর্যসেন হলের শিক্ষার্থী নাসিমুল শুভ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- এ কেমন ভুতুড়ে টিএসসি! পুলিশি ফাঁপড়ে বন্ধ চায়ের দোকান। বারেক, ইউনুস, স্বপন মামাদের (চা-দোকানি) বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে! প্রচণ্ড করিৎকর্মা প্রশাসন! অথচ চোখের সামনে লাশ পড়লেও টনক নড়ে না তাদের! মাথা নেই, ব্যথাও নেই। চা নেই, 'নাস্তিকদের' আড্ডাও নেই! এভ্রিথিং ইজ আন্ডার-কন্ট্রোল!!!! সাবাস বাংলাদেশ!
বঙ্গবন্ধু হলের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান ফেসবুকে লিখেছেন- টিএসসির অপরিহার্য একটি অনুষঙ্গ চায়ের দোকানগুলো। বছরের পর বছর ধরে এই দোকানগুলো বাঙালি চেতনা ধারণকারীদের সেবা প্রদান করে আসছেন এবং নিজেরাও পরিণত হয়েছেন সেই চেতনার অতন্দ্র প্রহরীতে। সেই দোকানগুলো হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কেন?
তিনি আরো লিখেছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে যদি এটা করা হয়, তাহলে তা অসুখে মাথা কেটে ফেলে দেওয়ার মতো সমাধান হবে। আর যদি দোকান বন্ধের পেছনে কারো ভাগ-বাটোয়ারাজনিত কারণ থাকে, তাহলে সেটা দুঃখজনক ও লজ্জার ঘটনা।
তবে অভিজিতের ওপর হামলার মূল স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটসংলগ্ন দোকানগুলো ঠিকই খোলা রয়েছে।
দোকানিরা জানান, ঘটনার পর থেকে ২/১ দিন বন্ধ রাখার পরে আবার তারা দোকানগুলো খুলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, হামলা হয়েছে সোহরাওয়ার্দীর উদ্যানের গেটে। বন্ধ যদি করতেই হয়, তবে গেটের কাছের দোকানগুলিই বন্ধ রাখা উচিত। কিন্তু টিএসসির দোকানগুলো বন্ধ রেখে অযথা কেন আমাদের ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে!
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ বাংলানিউজকে বলেন, অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে এবং বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে টিএসসির দোকানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কতদিন বন্ধ থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বিবেচনায় সময় মতো দোকানগুলো খুলে দেওয়া হবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের দোকানগুলোর ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বাংলানিউজকে বলেন, খোলা আছে নাকি! আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি!
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের দোকানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে গণপূর্ত বিভাগের নির্দেশে। তারা কেবল এতে সহায়তা করছেন মাত্র।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের খোলা দোকানগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ও গুলো তাদের না জানিয়ে খোলা হয়েছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) বইমেলা থেকে ফেরার পথে রাত পৌনে নয়টায় টিএসসি এলাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান গেট সংলগ্ন ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বিজ্ঞান-লেখক অভিজিৎ রায় এবং তার স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে আহত করে সন্ত্রাসীরা।
অভিজিৎ রায়কে মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। এ সময় হাত দিয়ে ঠেকাতে গেলে স্ত্রী বন্যার আঙুল কেটে মাটিতে পড়ে যায়।
সেই অবস্থাতেই তিনি ও একটি ফটো এজেন্সির ফটোসাংবাদিক জীবন আহম্মেদের সহায়তায় অভিজিৎ রায়কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মারা যান।
আর তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে মারাত্মক আহতাবস্থায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত মার্কিনি নাগরিক ও বিজ্ঞান-লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার পর দেশেবিদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে এ খবর প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশে আসার এক বছর আগে থেকেই অভিজিৎ রায় ইসলামী সন্ত্রাসবাদীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়ে আসছিলেন। তার দুটো বই এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়। সে উপলক্ষে তিনি ও তার স্ত্রী বইমেলায় গিয়েছিলেন। মেলা থেকে ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন তারা।
এর আগে একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদকে টিএসসি এলাকায় এবং বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী ও ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে মিরপুরে তার বাসার কাছে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়।
এর মধ্যে পরে জার্মানির গিয়ে ড. হুমায়ুন আজাদ মৃত্যুবরণ করেন এবং রাজীব ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সেই একই রকম পরিণতি ঘটেছে অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও।
এদিকে, ওই ঘটনার পর থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে টিএসসি এলাকার সবগুলো টং দোকান।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৫