ঢাকা, রবিবার, ১২ মাঘ ১৪৩১, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

রঙের খেলায় হোলিতে মাতে দোল উৎসব!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০১৫
রঙের খেলায় হোলিতে মাতে দোল উৎসব! ছবি : দীপুু মালাকার/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রঙের খেলায় মেতেছে সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মানুষ। একে অপরকে নানা রঙে রঙিন করে দেওয়ার এক মহাউৎসবে মেতে উঠেছেন তারা।



রঙ মাখামাখির আনন্দে মুখর তরণ-তরুণীরা। দোল উৎসবে রঙের হোলি খেলায় মেতেছেন তারা।

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) সকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে  গিয়ে এ চিত্র দেখা যায়।

দোলযাত্রা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মহানগর সর্বজনীয় পূজা কমিটির উদ্যোগে দোল উৎসব ও কীর্তনের আয়োজন করা হয়।

দোলযাত্রায় রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি পালকিতে বসিয়ে ভক্ত নারী-পুরুষ নাচ ও ভক্তিমূলক গান গেয়ে যাচ্ছেন। ‘দাদা, শুভ হোলি’ বলে একে অপরকে নানা রঙের রঙ ও আবির দিয়ে রাঙিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন তারা।

রাজধানীর অন্যান্য মন্দিরগুলোতেও দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির ও গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে ‘দোলপূর্ণিমা’ বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে ‘গৌরপূর্ণিমা’ নামেও অভিহিত করা হয়।

দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ দিকও রয়েছে। এদিন সকাল থেকেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে আবির, গুলাল ও বিভিন্ন ধরনের আবির খেলায় মত্ত হয়ে ওঠেন। শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে।

দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়। এই বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা নেড়াপোড়া নামে পরিচিত। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন উদযাপিত হয়।

দোলযাত্রা একটি হিন্দু বৈষ্ণব উৎসব। বহির্বঙ্গে উদযাপিত হোলি উৎসবটির সঙ্গে দোলযাত্রা উৎসবটি সম্পর্কযুক্ত। এই উৎসবের অপর নাম ‘বসন্তোৎসব’। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

জানা যায়, আর্যরা এটি পেয়েছিল অনার্য উৎস থেকে। ফাল্গুনের শুক্লা চতুর্দশীতে ও পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হতো হোলি উৎসব।

হোলাক বা হোলক নাম থেকে এসেছে এ উৎসবের নাম। সুশস্য উৎপাদনের প্রার্থনায় সৃষ্টি হয়েছিল এই উৎসব। জ্বালানো হতো ‘অজন্মা’ দৈত্যের খড়। উত্তর ভারতে বলা হতো- হিরণ্যকশিপুর ভগিনী ‘হোলিকার’ বিনাশ করেছিল ভক্ত প্রহ্লাদ। তাই, এই অগ্নির প্রয়োগ।

অন্য এক সূত্র জানাচ্ছে, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আরিয়ান জাতির কাছ থেকে এই উৎসবের জন্ম। হোলি উদযাপনের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্ট জন্মেরও কয়েকশ বছর আগে থেকেই হোলি উদযাপিত হয়ে আসছে।

এই উৎসবের নমুনা পাওয়া যায়, খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৩০০ বছর আগের পাথরে খোদই করা একটি ভাস্কর্যে। এই উৎসবের উল্লেখ রয়েছে, হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণে।

৭০০ শতকে দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময়ে সংস্কৃত ভাষায় লেখা একটি প্রেমের নাটিকাতেও হোলি উৎসবের বর্ণনা রয়েছে। পরে বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে খোদাই করা চিত্রকর্মে হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে ওঠে।

ইংরেজরা প্রথম দিকে এই উৎসবকে রোমান উৎসব ‘ল্যুপেরক্যালিয়া’ হিসেবেই মনে করেছিল। অনেকে আবার একে গ্রীকদের উৎসব ‘ব্যাকানালিয়া’-এর সঙ্গেও তুলনা করতো। কিন্তু এ ছিল একেবারেই এক দেশি উৎসব- প্রাণের উৎসব, আনন্দের উৎসব।

বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিল তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের ‘রত্নাবলী’ এবং অষ্টম শতকের ‘মালতী-মাধব’ নাটকেও এর বর্ণনা পাওয়া যায়। জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ ও ষোড়শ শতকের ‘রঘুনন্দন’ গ্রন্থেও এই উৎসবের অস্তিত্ব রয়েছে।

দোল বা হোলি ধর্মীয় অনুষঙ্গের আড়ালে থাকা এক সামাজিক অনুষ্ঠানও বটে, যার সর্বজনীন আবেদন আছে। দশেরা এবং দেওয়ালির মতো, অঞ্চলভেদে দোলেরও রয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা। উত্তর ভারতে যা ‘হোলি’ নামে পরিচিত, দক্ষিণে সেটাই আবার ‘মদনদাহন’ বা ‘কামায়ন’ উৎসব।

মধ্যভারতে এই উৎসবকে বলে ‘হোরি’। আবার গোয়া-কঙ্কণ অঞ্চলে একই ধরনের অনুষ্ঠান ‘শিমাগা’ নামে পরিচিত। উড়িষ্যায় যাকে ‘দোলোৎসব’ বলে, বাংলায় সেটাই ‘দোলযাত্রা’।

নামে যাই হোক না কেন, প্রতিটি উৎসবের চরিত্র প্রায় একই রকম। প্রথমে আগুন দিয়ে কোনো কুশ (বা ওই রকমই কোনো দাহ্যপদার্থ নির্মিত) পুতুল পোড়ানো। তারপর রঙ-আবির মেখে উচ্ছ্বাস বা উদ্দামতার প্রকাশ এবং এর মধ্যে অল্প বা পরিমিত নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা। বস্তুত, দোল বা হোলির উৎসব যতখানি না ধর্মীয়, তার থেকে অনেক অনেক বেশি সামাজিক।

নারী-পুরুষের ঘনিষ্ঠতা এখানে সমাজ-স্বীকৃত এবং তা খানিকটা শাস্ত্রসম্মত পথেই। বঙ্গদেশে বৈষ্ণব ধর্মের প্রসারের ফলে রাধাকৃষ্ণের প্রেম, বসন্তের রাসলীলা ও হোলি সমার্থক হয়ে গেছে।

পণ্ডিতেরা বলেন, রাধাকৃষ্ণের দোলনায় দোলা বা দোলায় গমন করা থেকেই ‘দোল’ কথাটির উৎপত্তি। বাঙালির দোল বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত একটি উৎসব হলেও রবীন্দ্রনাথ দোলযাত্রার ধর্মীয় অংশকে বাদ দিয়ে তার সাংস্কৃতিক দিকটিকে নিয়ে ‘দোলযাত্রা’কে ‘বসন্ত উৎসব’-এ রূপান্তরিত করলেন।

খানিকটা সেই সূত্র ধরেই দোল আমাদের কাছে প্রীতির উৎসব, প্রেমের উৎসব।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।