ময়মনসিংহ: ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’ কিংবা ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। ’
প্রবাদ অথবা কবি’র কবিতার মতোই ময়মনসিংহে দুর্গাপূজা আয়োজন করছেন নারীরা।
পূজার পরিকল্পনা ও উপকরণ কেনা থেকে শুরু করে প্রতিমা তৈরী, নান্দনিক মঞ্চ নির্মাণ, প্রসাদ ক্রয়, বিতরণ ও দু’দিনব্যাপী জাঁকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন থেকে শুরু করে সব রকমের কাজই সম্পন্ন করছেন ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন বিশিষ্ট পরিবারের সাহসী নারীরা। টানা ৬ বছর ধরে ভিন্নমাত্রার এমন আয়োজন হয়ে আসছে শহরের প্রাচীন ঐতিহ্যে ঘেরা শিববাড়ি মন্দিরে।
মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে শহরের ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরে গিয়ে বিশিষ্ট পরিবারের নারীদের পূজাকে ঘিরে কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, এ পূজার পরিকল্পনা, গোড়ার কথা ও ব্যতিক্রমী এ আয়োজনের আদ্যোপান্ত।
শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট পরিবারের নারীরা ২০১০ সালে সিদ্ধান্ত নেন শুধু তাদের উদ্যোগেই দুর্গাপূজা আয়োজনের। ওই বছরেই ‘শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। শুরুতে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩৫ জন।
এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ডা: হরিশংকর দাসের পত্নী শুক্লা দাশ ও শিববাড়ি মন্দির কার্যকরি কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বপন সেন গুপ্তের স্ত্রী সুচিতা সেনগুপ্তাকে। সিদ্ধান্ত অনুযাযী ওই সময় কমিটির সদস্যরা প্রতিদিন ৫ টাকা, ১০ টাকা করে জমা করতে শুরু করেন।
বছর শেষে দেখা যায়, একেকজনের ১ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা জমা করতে পেরেছেন। এরপর তারা উদ্যোগ নেন ‘বোধন’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশের। এ স্মরণিকাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা হয়।
‘আমাদের জমানো টাকা, ম্যাগাজিন থেকে প্রাপ্ত অর্থ আর শিববাড়ি মন্দিরের মূল কমিটির সহযোগিতায় ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আমাদের দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়’, বলেন শিববাড়ি মন্দিরের শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুচিত্রা সেনগুপ্তা।
তিনি জানান, ২০১০ সালে আমরা পূজা, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবক, আলোকসজ্জা, অর্থ বিষয়ক ও শৃঙ্খলা উপ-কমিটি গঠন করি। সভা করে নিজেরাই দায়িত্ব বুঝে নিয়ে প্রতিমা কেনা থেকে শুরু করে সব কাজই সফলতার সঙ্গে শেষ করেন।
সাহসী ও উদ্যমী নারীদের সম্মিলিত উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায় সফলভাবে দুর্গাপূজা সম্পন্নের খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। প্রবাসে থাকা নারীরাও তাদের এ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের জড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৩৫ সদস্য থেকে এখন তাদের আকার দাঁড়িয়েছে ২৬০ সদস্যে। এর মধ্যে আমেরিকা, কানাডা, ভারত ও লন্ডনের ৯ জন নারী সদস্য।
অষ্টমী ও দশমী পূজার দিন কমিটিভুক্ত সব নারীই একই রকমের শাড়ি পরবেন। তাদের গলায় ঝুলবে কমিটির পরিচয় পত্র, এমন তথ্য জানিয়ে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুচিতা সেনগুপ্তা বলেন, একই রকম শাড়ি পড়ে কাল অষ্টমী পূজোতে অঞ্জলি দেবো। দশমীতেও একই শাড়ি পড়ে সিঁদুর খেলা খেলে দুর্গা মাকে ব্রক্ষপুত্র নদের তীরে বিসর্জন দেবো।
দৃঢ়তা নিয়ে এ নেত্রী বলেন, পূজার কাজগুলো নারীরা সব সময় নেপথ্যে থেকেই করে। কিন্তু গত ৬ বছর ধরে আমরা সামনের কাতারে এসে কাজ করছি। নিজেরাই সফলভাবে দুর্গাপূজা উৎসব আয়োজন করছি। সমাজে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার এটিও একটি বড় দৃষ্টান্ত।
পাশেই দাঁড়ানো সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সীমা দত্ত ও সাজসজ্জা পরিষদের আহবায়ক দীপু সেন গুপ্তা বলেন, পূজার দাওয়াতপত্র আমরাই দলবেঁধে বিলি বণ্টন করি। আমাদের নিজস্ব উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে দুর্গোৎসব আয়োজনের যাত্রা আমাদের হাত ধরেই গোটা দেশে শুরু হয়। এছাড়াও আমরা সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক কর্মসূচিও পালন করছি।
জানতে চাইলে শিব মন্দির কার্যকরি কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বপন সেন গুপ্ত বলেন, প্রথম দিকে আমাদের ধারণা ছিল নারীরা এক বছর এ উৎসব পালন করে পরের বছর আর পারবে না। কিন্তু আমাদের ধারণা নারীরা পাল্টে দিয়েছে। আমরা গর্বিত আজ নারীদের আয়োজনে দুর্গোৎসব ৬ষ্ঠ বর্ষে পদার্পণ করেছে। নারীরা সফল আয়োজক এটাও প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৫
জেডএম/