মাখনেরচর, দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর থেকে: ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে দৌড়াতে থাকি আমরা। ক্ষেতের আইল না মেনে ফসলি জমির ওপর দিয়েই জান রক্ষার দৌড়।
পেছনে বৃংহতি যেন কানের আরও কাছে এগিয়ে আসছিল। টর্চ হাতে এলোমেলো দৌড়াতে থাকেন আমাদের জামালপুর করেসপন্ডেন্ট গোলাম রাব্বানি নাদিম। তাকে পেছনে ফেলে আমি দৌড়ালাম। ক্যামেরা হাতে, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ফটো করেসপন্ডেন্ট শাকিল হয়তো আরও আগেই মাঠছাড়া। বুনো হাতির ১০০ মিটার কাছ থেকে যেসব গ্রামবাসী ছবি তুলতে সাহায্য করতে চেয়েছিল তারাও দৌড়াচ্ছে।
রাত তখন প্রায় ১০টা। হাতির পালটি প্রথমে টর্চ হাতে আমাদের দেখে কয়েক গজ পেছালো। সাহসী একজন গ্রামবাসী একাই টর্চের আলো দিয়ে বেশ কয়েক গজ পিছিয়ে দিয়েছিল দলটিকে। আমরাও এগিয়ে গিয়েছিলাম, লক্ষ্য শাকিল ভাইয়ের ছবি তোলা। একসঙ্গে দুটি টর্চ লাইট ধরা হলো। কিন্তু ৬০ থেকে ৮০ সেকেন্ডের মধ্যে পেছন ফিরে হাতির পালের যৌথ আক্রমণ।
আমাদের টর্চের এলোমেলো গতি আর দৌড় দেখে এরই মধ্যে গ্রামের ভিটার পাড় থেকে গ্রামবাসীর হৈ হৈ আওয়াজ আর টর্চের আলো বেড়ে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ছোট দলটি ভিটার অংশে পৌছালাম। অক্টোবরের শীত শীত ভাব আর নেই। রীতিমত ঘামিয়ে উঠেছি আমরা।
কিছুক্ষণের মধ্যে বড়ই বাগানের ফাঁক গলে গ্রামের ভিটা অংশের পাশের জমিতে এসে পড়লো হাতির পাল। আমাদের পেছনে ধাওয়া করেই এত তাড়াতাড়ি গ্রামের এত কাছে চলে আসে। গ্রামবাসী জানালেন, এতো কাছে সাধারণত রাত ১২টার আগে আসে না।
গ্রামটিতে পুরুষ মানুষের অভাব রয়েছে। দুটি হাতি হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২০ জনের বিরুদ্ধে করা পুলিশের মামলায় অনেক পুরুষ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। হৈ হৈ আওয়াজ করা, দূরে কয়েকজনের টিনের পাত্রে বাড়ি আর কিছু পাটকাঠিতে আগুন দেওয়া ছাড়া গ্রামবাসীর আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়লো না হাতি তাড়াতে। টর্চ লাইটগুলোর ব্যাটারির ক্ষমতা ফুরানোর বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাদের।
পালের বেশ কয়েকটি হাতি বড়ই বাগানের ফাঁক গলে ধান ক্ষেতে তখন। মনের ইচ্ছেমতো জমির ধান সাবাড় করছে তারা। তবে গ্রামবাসী জমি নয়, বরং ভিটার ওপরের ঘরগুলোতে যেন আক্রমণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখছেন।
দু’একটি পটকা ফোটানো হলো। কিন্তু তার মজুদও কম। আর ভিটার এ সীমানায় ৫টি সোলার বাতি দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ বাতিতে প্রায় ৪০ সদস্যের হাতির পাল বাধা পড়বে বলে সাহস করছে না গ্রামবাসী। পালে বেশ বড় আকারের হাতি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাচ্চা হাতিও।
বিকেলে আবার মাখনেরচর যাওয়ার আগে পাশের পাথরেরচর গ্রাম ঘুরে গিয়েছিলাম আমরা। সেখানেই দেখা হয় কামালপুরের কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে। তারা পাথরের চরে একটি বাগান ইজারা নিয়ে কাজ করছেন।
কামালপুরের জাহাঙ্গীর এবং মিল্লাত বাংলানিউজকে বলেন, শুধু ভারত থেকেই আসে না হাতি। তাদের এলাকার পাহাড়ও রয়েছে। সেখান থেকেও নামে হাতির পাল। তবে গ্রামবাসী বেশ ভালোভাবেই জানেন, কীভাবে হাতিকে সরিয়ে দিতে হয়।
দুই তরুণ জানালেন, হাতি তাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর প্রক্রিয়াটি হলো, কাপড়ের ত্যানাকে মুড়িয়ে বলের আকার করে কেরোসিন দিয়ে আগুন বোমা তৈরি করা। তাদের এলাকায় এ হাতির পাল এলে একসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি আগুন বোমা মারলেই হাতিরা আবারও ফিরে যায় নিজেদের ডেরায়। ক্ষতি করতে পারে না ফসলের। এছাড়াও ফাঁপা নলের সাইরেন এবং উচ্চ ক্ষমতার টর্চ লাইটও রয়েছে তাদের। এর ফলে গত কয়েক বছরে গ্রামে কোনো হাতি বা হাতির চাপায় মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা নেই।
ডাংধরা ইউনিয়নের মেম্বার আলতাফ হোসেন মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) দিবাগত রাতে মাখনেরচরে বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামবাসীকে এ ধরনের কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের কেরোসিন বা অন্য কোনো প্রতিরোধক ব্যাবস্থা দেওয়া হয়নি। গ্রামবাসী যে পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করছে তা একান্তই নিজস্ব।
তবে এভাবে ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করার পরেও হাতিগুলোকে বাধা না দেওয়ার আরেকটি কারণ জানালো গ্রামবাসীরা। গ্রামের ভিটা অংশ শুরুর আগ পর্যন্ত যে ধানক্ষেতগুলো, তার পুরোটাই নদীর পশ্চিম পাড়ের বাঘারচরবাসীর।
বেশ আতঙ্কজনক অবস্থায় রয়েছে মাখনেরচরবাসী। গত শনিবার দিবাগত রাতে বাঁশ ও বৈদ্যুতিক তার দিয়ে যে ফাঁদ পাতার কথা প্রথমে অনেকেই স্বীকার করলেও এখন সবাই লা-জওয়াব। পুলিশি হয়রানির ভয়ে সবাই ফাঁদের প্রসঙ্গে নীরব। তবে হাতির দাঁত, শুড় এবং কান কেটে নেওয়ার ব্যাপারটিতে বিস্মিত তারাও।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৫
এমএন/এমজেএফ
** সন্ধ্যার পর নামছে হাতি, দূরত্ব বাড়ছে মানুষের সঙ্গে