ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের নোটিশকে পরোয়া করছেন না ঢাকা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাসিনা দৌলা। যাচ্ছেন না কমিশনের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে।
সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলা থাকেন সাভারের আশুলিয়ার কুটুরিয়া গ্রামে। মাটির একটি ছোট্ট ঘরে। স্বামী মাইক্রো ইলেকট্রনিক্সের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী মফিউদ্দৌলা মারা গেছেন অনেক আগেই।
আড়াই বিঘা জমিতে থাকা মাটির ঘরটির চারপাশে গাছ-গাছালি। বেশির ভাগই অর্কিড। কড়া নিরাপত্তা, চারপাশে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ক্যামেরা। উঁচু প্রাচীর ও বিশাল ফটক।
পরিচয় দেওয়ার পর অনুমতি পেয়ে তবেই তার বাড়িতে ঢোকার সুযোগ হয়। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ে নজরকাড়া প্রকৃতির সৌরভ ছড়ানো সৌন্দর্য। এক কথায় ছিমছাম পরিবেশ। বাইরের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজ। পাখির কিচির-মিচিরের মধ্যে ছন্দময় এক পরিবেশ।
হাসিনা দৌলার ছেলে-মেয়ে, নাতিরা থাকেন ঢাকায়। পরিচারিকা নিয়ে তিনি একা এখানে থাকছেন দীর্ঘদিন ধরে। মাটির ঘরে বসবাসকে কবরের কাছাকাছি বসবাস করার মতোই মনে করেন তিনি।
আর তার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল দেখিয়ে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুদক।
দুদকের অভিযোগের বিষয়ে জানতেই বুধবার (২১ অক্টোবর) সকাল ১০টায় রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির প্রধান দপ্তরে তলব করা হয়েছিলো হাসিনা দৌলাকে। কিন্তু তিনি যাচ্ছেন না।
‘আমি কি মিডিয়ার খোরাক হতে যাব?’ বাংলানিউজকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে হাসিনা দৌলা বলেন, ‘আমি কি দুর্নীতি করেছি যে আমাকে যেতেই হবে। আমার যা বলার তা আমি লিখিতভাবেই জানিয়ে দিয়েছি। তাহলে যাব কেন?
জেলা পরিষদের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্পের ভুয়া বিল দেখিয়ে শত কোটি টাকা নয়-ছয় করার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরেই ছিলো গণমাধ্যমের আলোচনায়। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশনের সভায়। সেই ধারাবাহিকতায় গত ১১ অক্টোবর দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তাকে তলব করে পাঠানো হয় ‘নোটিশ’।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই নোটিশে হাসিনা দৌলাকে ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়।
‘নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মৃদু হুশিয়ারিও দেওয়া হয় ওই নোটিশে।
পরদিন গত ১২ অক্টোবর ঢাকা জেলা পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী, বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ ৭০ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, আশুলিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ, ধামরাই এবং রাজধানীর কোতোয়ালি, গুলশান ও তেজগাঁও থানায় ১৫টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
একেতে জেলা পরিষদের একমাত্র নারী প্রশাসক। ‘শিল্পপতি’ পরিচয় ছাপিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের একমাত্র নারী সভাপতি তিনি। এসব কিছু মিলিয়ে তাকে দুদুকে তলবের খবরটি গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পায়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তলবি নোটিশ মোকাবেলার প্রস্তুতির হাল নাগাদ খবর জানতেই সাত সকালে হাসিনা দৌলার বাড়িতে হাজির হয় বাংলানিউজ।
মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে তখন তিনি দলীয় নেতাদের নিয়ে ব্যস্ত স্থানীয় রাজনীতি আর আসছে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে নিজ দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন সংক্রান্ত আলোচনায়। কথার ফাঁকে ফাঁকে যত্নআত্তি করছেন মাটির ঘরের বারান্দার টবে ঝুলে থাকা গাছগুলোর।
এর মাঝে গাছের আড়ালে খাঁচায় থাকা ‘ঘুঘু’ পাখির ডাক। আবার নীরবতা ভেঙে খান খান করে দেওয়া ম্যাকাও পাখির চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাখিদের খাবার দেওয়া হয়েছে কিনা তাও জানতে চাইছেন পরিচারিকাদের কাছে।
সব মিলিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে। বয়সের জন্যেই যতটুকু। তার চাইতে এক চুল বেশিও ভাঁজ পড়েনি কপালে। সকাল সাতটা থেকে আটটা। সময় গড়িয়ে যায়। তা সত্ত্বেও নেই কোনো তাড়া।
নিজের সময় আর দিন জ্ঞানের ভুল হলো না তো! এই চিন্তায় হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ে এই প্রতিবেদকের। ঘড়ির কাঁটা আর ক্যালেন্ডার মিলিয়ে নেই। হ্যাঁ, আজই তো ২১ অক্টোবর। বুধবার। আজই তো দুদুকে সবাই অপেক্ষায় আছে হাসিনা দৌলার জন্য। তাহলে?
‘তাহলে আবার কি? আমি যাচ্ছি না দুদকে। কেনই বা যাব? মিডিয়ার খোড়াক হতে? আমার কাছে যা যা জানতে চেয়েছে তার সবই তো এক পৃষ্ঠার চিঠিতে আমি জানিয়ে দিয়েছি। তাহলে আবার যেতে হবে কেন? চেহারা দেখাতে?-সাবলীল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে যান হাসিনা দৌলা।
কবে নোটিশ পেলেন?- ‘আমি তো সরাসরি কোনো নোটিশই পাইনি। আমাকে মন্ত্রণালয় থেকে দুদুকের নোটিশটি পাঠানো হয়েছে। আমি নোটিশটি পড়লাম। সেখানে কিন্তু মন্ত্রণালয়কে কোনো অনুলিপি দেয়নি। তাহলে নোটিশটি আমি পেলাম না। পেলো মন্ত্রণালয়। মনে হয় ষড়যন্ত্র এর মধ্যেও আছে। ’
ওয়ানের-ইলেভেনের সময় থেকেই দুদুকের নোটিশ মানেই ঘুম হারাম। হিসাবের খাতা মেলাতে গিয়ে ঘাম ঝড়ে যায় নোটিশ প্রাপ্যদের।
সেই দুদকের নোটিশ প্রাপ্তির পর আবার তলবের দিনে ফুরফুরে মেজাজে থাকার রহস্য কী? এবার না হয় পাত্তাই দিলেন না। যদি আবার ডাকে?- ‘যখন ডাকবে তখন দেখা যাবে। আমি তো লিখিতভাবে যা বলার তা বলেই দিয়েছি। তারা তো বহুবার আমার অফিসে গিয়েছে। আমার সাথে কথা বলেছে। নতুন করে আবার আমাকে সেখানে ডাকার দরকার কী?’
হাসিনা দৌলা আরো বলেন, ‘আমি মনে করি সেখানে গণমাধ্যমের খবরের খোড়াক হওয়া ছাড়া সশরীরে যাবার তেমন কোনো তাৎপর্য নেই। প্রবেশ কিংবা বেরিয়ে আসার পথে এত এত ক্যামেরা। গণমাধ্যমকর্মীদের নানা প্রশ্ন। এসব আমার জন্য অস্বস্তিকর। ’
‘আসল ট্রায়ালটা তো এখানেই হয়ে যায়। যাতে বলে মিডিয়া ট্রায়াল। সামাজিক মর্যাদাহানির এক উৎসব। ভবিষ্যতে তদন্তে দুর্নীতির সম্পৃক্ততা না পেলেও তখন ‘দায়মুক্তি’ নিয়ে আবার চলে হৈ চৈ। বয়স হয়েছে কবরে যাবার। এখন আমার জন্যে এই বিষয়টি স্পর্শকাতর। বলতে পারেন চরম অস্বস্তিকর’- যোগ করেন হাসিনা দৌলা।
সমস্যা কী তাহলে মিডিয়া নিয়ে? এ পশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, আমি ওভাবে কাউকে ইঙ্গিত করছি না। সামগ্রিক বিষয়টি বললাম মাত্র। আমি দুর্নীতি করেছি না কি করিনি- তা জানতে গণমাধ্যমকর্মিদের সাভারে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তারাও যাচাই করুক। অনুসন্ধান করুক। আমার দুর্নীতি নিয়ে। সত্যি কথাটাই তুলে ধরুক। আমি খুশি হব। ’
‘দুর্নীতিই যদি করতাম, তাহলে নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী) আমাকে ছাড় দিতেন না। সরিয়ে দিতেন আমার পদ থেকে। আর এভাবে আমি মাটির ঘরে থাকতাম না। আমার ঠিকানা হতো আলিশান বাড়িতে। ’
ছোট্ট মাটির কুটিরে হাসিনা দৌলার বসবাস আর শত কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগের অসম্ভব বৈপরীত্য নিয়ে এমনিতেই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। নিজ দলেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও হাসিনা দৌলাকে এক হাত নিতে এই ইস্যুতে শান দিচ্ছেন হাতিয়ারে।
তবে হাসিনা দৌলার সাফ কথা- দুর্নীতি করিনি। করার প্রশ্নই ওঠে না। সেটা করলে আমার ৬৮ বিঘা জমি বিক্রি করতে হতো না। রাজনীতির জন্যে আজ নিঃস্ব হতে হতো না।
তার সন্দেহ, জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।
‘তবে কষ্ট হলো এসবের সঙ্গে বিনষ্ট হচ্ছে খোদ দলেরও ইমেজ’ এমন মন্তব্য করে হাসিনা দৌলা আরও বলেন, আমি হলফ করে বলতে পারি আমি দুর্নীতি করিনি। তবে জেলা পরিষদে দুর্নীতি যে হয়নি তা কিন্তু নয়। হয়েছে, তবে সেটা ছোট ছোট প্রকল্পে। আমিই উদ্যোগ নিয়েছি দুর্নীতির মূলোৎপাটনের। আর আমি কেঁচো খুঁড়তেই বেরিয়ে এসেছে সাপ। আমি জেলা পরিষদের প্রশাসক। প্রকৌশলী থেকে সচিব, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমোদন হয়েই কিন্তু ফাইল এসেছে আমার কাছে।
কেউ যদি ভুয়া প্রকল্পের নামে অর্থ ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে তবে তার দায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের। তারা কোন হিসেবে টাকা দিলো? সবাই ফেঁসে যাবেন। ভয়ে অনেকেই এখন দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট করা টাকা ফিরিয়ে দিতে চাইছেন।
তাহলে দুদুকের মুখোমুখি হতে সমস্যা কোথায়? এ প্রশ্নের জবাবেও তার একই উত্তর, আমি কেন যাব। আমি তো কোনো দুর্নীতি করিনি।
তার এ অবস্থান যে নতুন করে তার ওপর দুদুকের অনুসন্ধান আর কৌতূহলের আলো ফেলবে। সেটাই যেন এখন আপাতত এক অনিবার্য পরিণতি। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়েও তিনি জানান দিতে চান- তিনি হাসিনা দৌলা। ঢাকা জেলা পরিষদের প্রশাসক।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৫
জেডআর/এমজেএফ/