ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

মানত করে হোসনী দালানে আসতো সানজুর পরিবার

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৫
মানত করে হোসনী দালানে আসতো সানজুর পরিবার ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘মায়ে তক্তা হয়ে (শোকে পাথর) গেছে। এখন আর কান্দে না! কিছু কইতেও পারে না।

’ অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন পুরান ঢাকার হোসনী দালানের পাশে আশুরার মিছিলে বোমা হামলায় নিহত সাজ্জাদ হোসেন সানজুর (১৫) বড়বোন নাছরিন আক্তার।
 
শুক্রবার (২৩ অক্টোবর) দিনগত রাত ২টার দিকে তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণের এ ঘটনা ঘটে। অসুস্থ মা রাশেদা বেগমকে পিঠা কিনে খাওয়ানোর পর পরিবারের সঙ্গে রাত ১০টায় হোসনী দালানে যায় সানজু।

দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের পূর্ব চড়াইলে শুভাট্টা উত্তর পাড়ায় পরিবারের সঙ্গে বাস করতো সানজু। স্থানীয় নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিল সে।

সুন্নি সম্প্রদায়ের হওয়া সত্ত্বেও গত দু’বছর ধরে হোসনী দালানে আশুরার মিছিলে অংশ নিচ্ছিল সানজুর পরিবার। সানজুর বড়ভাই রাশেদের ছেলে সিহাব (৫) জন্মের পর প্রথম দু’বছর কোনো কথা বলতে পারেনি। একটা পর্যায়ে সিহাবের মা সুমি আক্তার মানত করেন, ছেলে কথা বলতে পারলে প্রতি বছর তারা আশুরায় হোসনী দালান থেকে বের হওয়া মিছিলে অংশ নেবেন। পরিবারটির বিশ্বাস, এই মানতের পরেই কথা বলতে শুরু করে শিশু সিহাব। এরপর গত দু’বছর ধরে সানজুর পরিবার আশুরার মিছিলে অংশ নিচ্ছেন।

পাঁচ ভাই ও দুই বোনের সংসারে সানজু সবার ছোট। কলিজার টুকরো ছোট ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা রাশেদা বেগম। দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জে সানজুর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়া-প্রতিবেশিরা রাশেদা বেগমকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। সন্তান হারানোর শোকে তিনি একদম পাথর হয়ে গেছেন। অশ্রুসিক্ত এই মা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর পর জোর নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তার কাছ থেকে। শোকের ভার বহন করা যেন তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সন্তানের মৃত্যুর পর থেকে চোখের জল আর আহাজারিতে শেষ শক্তিটুকুও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে।
 
সানজুর বড় বোন নাছরিন আক্তারকে দেখা গেল ভাই হারানোর কষ্ট বুকে চেপে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, মায়ে তক্তা হয়ে গেছে। এখন আর কান্দে না! কিছু কইতেও পারে না।

মাকে লক্ষ্য করে তিনি আবার বলেন, ‘মা আবার একটু কান্দার চেষ্টা করেন, বুকটা হালকা হবে। ’
 
এদিকে, মা রাশেদা বেগম নিরবে চোখের পানি ফেলছেন। ধীরে ধীরে কথা বলে উঠলেন তিনি, পুলা আমারে বাজার থেইক্কা পিঠা কিনা খাওয়াইছে। বাসায় পুলা আর ফিরবে না, এইটা কে জানে!
 
সানজুর বাবা নাসির মিয়া বংশালে রেক্সিন কারখানায় কাজ করেন। পাঁচ বছর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেরানির চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি।

শোকে পাথর নাসির মিয়া বলেন, কার নামে মামলা করবো! কে মারছে আমার পুলারে? সরকাররে কইছিলাম পুলারে যেন পোস্টমোর্টেম না করে, সরকার তাও করছে। সরকারের কাছে দাবি, তারা যেন খুনিরে খুঁজে বের করে!
 
শুধু সানজুর মৃত্যুতেই এই পরিবারের ট্রাজেডি থেমে নেই, বোমা হামলার ঘটনায় তাদের আরও পাঁচ সদস্য আহত হয়েছেন। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন সানজুর খালা আয়েশা বেগম। এছাড়া তার ভাবী সুমি আক্তারও পায়ে আঘাত পেয়েছেন। আর সানজুর ভাগনির পেটে ঢুকেছে স্প্লিন্টার।
  
আদরের ছোট দেবরকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল সুমি আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ছেলে সিহাবের জন্য করা মানত রাখতে দু’বছর ধরে আশুরার মিছিলে অংশ নিচ্ছি। শুক্রবার দিনগত রাত ১০টার দিকে হোসনী দালানে যাই আমরা। রাত দেড়টার পর হঠাৎ বোমার শব্দ। আমার চোখের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সানজু। আমার মেয়ে স্নেহাও বোমার আঘাতে আহত হলো। চারদিকে শুধু চিৎকার আর কান্নার আহাজারি। সবাই ছুটোছুটি করছিল। কিছুক্ষণ পর হোসনী দালানের লোকজন এসে সানজুকে হাসপাতালে নেয়। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে। আমার মনে হয়, ও হোসনী দালানেই মারা গেছে। পিঠের অংশ বোমায় পুড়ে কালির মতো হয়ে গিয়েছিল।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৫
এমআইএস/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।