ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

৯ নড়িয়ে ভাগ্য বদল!

আদিত্য আরাফাত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
৯ নড়িয়ে ভাগ্য বদল! ছবি : প্রতীকী

ঢাকা: জেসমিন আক্তার। বর্তমানে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার খাদ্য পরিদর্শক।

২০১১ সালে এ পদের জন্য লিখিত পরীক্ষা দিয়ে তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ১৯ নাম্বার। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও নিয়োগ কমিটি তার ১৯ নম্বরকে বানিয়েছেন ৯১! ৭২ নাম্বার বাড়িয়ে অযোগ্য জেসমিন আক্তারকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

শুধু জেসমিন আক্তার নন, ভয়াবহ জালিয়াতি করে লিখিত পরীক্ষায় এরকম ৪৪ জনের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বঞ্চিত করা হয়েছে যোগ্য ও মেধাবীদের। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান প্রতিবেদনে নিয়োগ জালিয়াতির এসব তথ্য রয়েছে। বাংলানিউজের কাছেও এ জালিয়াতির দালিলিক বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে খাদ্য পরিদর্শক পদে জালিয়াতির তথ্য পেয়েছি। যোগ্যদের বঞ্চিত করে নাম্বার টেম্পারিং করে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এ দুর্নীতির এখন তদন্ত চলছে। অনুসন্ধানের পর তদন্তে এ ঘটনা আরও বিষদভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দালিলিকভাবে যাদের অপরাধ প্রমাণ হবে দুদক তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করবে।

বাংলানিউজের কাছে থাকা তথ্যে দেখা যায়, জেসমিন আক্তারের মতো এরকম বাকি ৪৩ জনের প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ পেলেও তারা বর্তমানে খাদ্য পরিদর্শক পদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত রয়েছেন।
 
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায় নিয়োগ পাওয়া আসমা ইসলামের (বর্তমানে ঢাকা খাদ্য অধিদপ্তরে হিসাব ও অর্থ বিভাগে সংযুক্ত) ওএমআর শিটে (প্রশ্ন ও উত্তরপত্র) ২৬ নম্বর লেখা থাকলেও তাকে ফলাফলে ৮৯ দেখিয়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছে।

ঢাকা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে সংযুক্ত থাকা শরীয়তপুর সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের মুহাম্মদ তাজুল ইসলামের ওএমআর শিটে ৫৫ নম্বর থাকলেও তাকে ৮৯ দেখিয়ে উত্তীর্ণ করা হয়েছে, সিলেট কোম্পানীগঞ্জের মো. জহিরুল ইসলামের ৫০ নম্বরকে দেখানো হয়েছে ৯০, গাজীপুরে সংযুক্তিতে থাকা ফরিদপুর বোয়ালমারীর আসমা রহমানের ওএমআর শিটে ৪৮ নাম্বার থাকলেও তার ফলাফলে নাম্বার দেখানো হয়েছে ৮৯, সিলেট সদর উপজেলার অপূর্ব কুমার রায়ের ২৫ নম্বরকে দেখানো হয়েছে ৯০।

এছাড়া সাভারের খাদ্য পরিদর্শক আবু জাকির মোহাম্মদ রিজওয়ানুর রহমান, মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের আসমা ইসলাম, সিলেটের বিয়ানীবাজারের জাহানারা জলি, শেরপুরের নয়াবিল টিপিসির অলিউর রহমান, জামালপুর সদরের সানজিদা সুলতানা, কিশোরগঞ্জের সরারচর এলএসডির উম্মে হানী, সিলেটের বিশ্বনাথের মোহাম্মদ মোহাইমিনুল ইসলাম ভূঞা, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জের প্রতাপ কুমার সরকার, পাবনার চাটমোহরের কোহিনুর আক্তার, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার মির আরিফুর রহমান, নেত্রকোনার কলমাকান্দার মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব, ময়মনসিংহের গয়েশপুরের মো. সাজ্জাদ হোসেন খান পাঠান, নেত্রকোনো সদরের হিমেন চন্দ্র সরকার, ঢাকা সিএসডির মোহাম্মদ রইছ উদ্দিন, শেরপুর সদরের সালমা আক্তার, জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ এলএসডির শামছুন নাহার, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের ইয়াসির আরাফাত, টাঙ্গাইলের নাগরপুরের মো. এদিব মাহমুদ, পটুয়াখালীর গলাচিপার হালিমা আহমেদ, ঝালকাঠি সদরের রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, কুমিল্লার বরুড়ার মোহাম্মদ তৈয়ব উল্যাহ খান, নওগাঁর ধামুইরহাটের শেখ মো. জাকারিয়া হাসান, বদলগাছীর মো. নুরুজ্জামান, পোরশার মো. আতিকুর রহমান, বগুড়ার শিবগঞ্জের মমতাজ বেগম, জামালগঞ্জ এলএসডির কানিজ শারমিন, পাবনার আটঘরিয়ার মো. জুনায়েদ কবীর, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের সেলিনা আক্তার, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের মোহাম্মদ আলী মিঞা, রংপুরের মিঠাপুকুরের রানীপুকুর টিপিসির জাকিয়া সুলতানা, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের অনিমেষ কুমার সরকার, নীলফামারীর জলঢাকার জেসমিন আক্তার, সৈয়দপুরের মো. রায়হান কবির, রংপুর সদর পীরগঞ্জের মিঠাপুকুর টিপিসির মো. শরিফুল ইসলাম, সাতক্ষীরার দেবহাটার বিল্লাল হোসেন, বাগেরহাটের মংলার মো. আবুল হাশেম, পটুয়াখালীর কাঠালতলীর ইসরাত জাহান মান, বরগুনার আরিফা সুলতানা, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আশীষ কুমার রায় ও চাকরিতে যোগ না দেওয়া মো. আবুল কাসেম। এ খাদ্য পরিদর্শকদেরও নাম্বার বাড়িয়ে উত্তীর্ণ দেখিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করে বর্তমানে সংস্থার উপ-পরিচালক হামিদুল এ দুর্নীতির বিষদ তদন্ত করছেন।

চাকরি পাওয়া ৪৪ জন ছাড়াও আরও ৯ জনও এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেন দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ঠ সূত্র বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছে। এরা হলেন- খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) ও বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সভাপতি (বর্তমানে পরিচালক-সংগ্রহ) ইলাহী দাদ খান, খাদ্য ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব (বর্তমানে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব) নাসিমা বেগম, সরকারি কর্মকমিশনের সাবেক উপপরিচালক ও উপসচিব মাহবুবুর রহমান ফারুকী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইফতেখার আহমেদ ও সিনিয়র সহকারী সচিব রোকেয়া খাতুন, ডিপিসির ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আইউব আলী, সাবেক সিস্টেম অ্যানালিস্ট আসাদুর রহমান, হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আরিফ হোসেন ও অ্যাসিসট্যান্ট ডেটাবেজ অ্যাডমিন আবুল কাসেম। এদের বিরুদ্ধে পরষ্পর যোগসাজশে নাম্বার বাড়ানোর প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে দুদক। প্রাথমিকভাবে এ অভিযোগে গত ৭ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগ থানায় দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল হক বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।

খাদ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় নির্বাচন কমিটির সভাপতি ইলাহী দাদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেলে তিনি তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাছাই কমিটির সদস্য ও ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্টসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা কম নম্বর পাওয়া ৪৪ পরীক্ষার্থীর লিখিত পরীক্ষার ওএমআর শিটে প্রাপ্ত নম্বর ঘষামাজা করে বাড়িয়ে ফল প্রকাশ করা হয়েছে। বাছাই কমিটির সদস্যদেরও স্বাক্ষর আছে ওই তালিকায়।

দুদক সূত্র জানায়, জালিয়াতির মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত প্রত্যেককে আগামী সপ্তাহে তদন্তের প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

খাদ্যে নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে যোগ্যরা বঞ্চিত হয়। দুদকের উচিত তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে আইনুনাগ ব্যবস্থা নেওয়া। ’

এসব দুর্নীতির কার্য্যকরী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে অন্যান্য দুর্নীতি কমবে বলে তিনি মনে করেন।

জানা যায়, খাদ্য অধিদপ্তরের ১০ শ্রেণির এক হাজার ৫৫২ পদে লোক নিয়োগের জন্য ২০১০ সালে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। এতে মোট আবেদন করেন তিন লাখ ৮৭ হাজার ৪৩৭ জন। ২০১১ সালে লিখিত পরীক্ষা হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২৩০ জন। ২০১৩ সালে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় এবং গত ৫ এপ্রিল এই নিয়োগ কার্যক্রম শেষ হয়। চূড়ান্ত ফলাফলে উত্তীর্ণ হন এক হাজার ১৭৫ জন। এদের ৩২৮ জনকে খাদ্য পরিদর্শক পদে গত বছরের মে মাসে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৩২৮ জনের মধ্যে ৪৪ জনের খাতায় জালিয়াতির তথ্য পায় দুদক।

শুরু থেকেই এই নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন তখনকার খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। দুদকের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অনুসন্ধানে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরি পাওয়া ৪৪ জন, বাছাই কমিটির ৫ সদস্য এবং আইটি প্রতিষ্ঠানের ৪ জনসহ ৫৩ জন পরষ্পরের যোগসাজশে এ জালিয়াতি করেছেন। ‘গোপন আঁতাতের মাধ্যমে’ এ নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, খাদ্য পরিদর্শক পদে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাছাই কমিটির ৫ সদস্য এবং আইটি সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান ডেভেলপমেন্ট প্লানার্স অ্যান্ড কনসালট্যান্স (ডিপিসি) এর ৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করতে আইনিভাবে বাধ্য থাকলেও তারা পরীক্ষায় ফলাফল প্রকাশে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করেছেন। প্রাপ্ত নম্বর পরিবর্তন করে অযোগ্য ও দুর্বল প্রার্থীদের তারা উত্তীর্ণ দেখিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।