ঢাকা: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামালপুরের আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট ও মরদেহ গুমের পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
আগামী ১৮ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর দিন ধার্য করা হয়েছে।
সোমবার (২৬ অক্টোবর) অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।
একই মামলার আট আসামির মধ্যে দু’জন অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই এবং এস এম ইউসুফ আলী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। পলাতক বাকি ছয়জন হলেন- আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আব্দুল হান্নান, মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন ও মো. আবুল কাসেম। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেননি বা গ্রেফতার হননি।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ও ৭ অক্টোবর আট আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ও তাপস কান্তি বল। অন্যদিকে অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে শুনানি করেন গ্রেফতার হওয়া অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই ও এস এম ইউসুফ আলীর পক্ষে এ ওয়াই এম মশিহুজ্জামান, পলাতক মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন ও মো. আব্দুল হান্নানের পক্ষে আব্দুস সোবহান তরফদার এবং মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন ও মো. আবুল কাসেমের পক্ষে এম এইচ তামিম ও কুতুবউদ্দিন আহমেদ।
গত ২৯ এপ্রিল ওই আট আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকউশনের দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
ঘটনার ৩৪ জন ও জব্দ তালিকার ৬ জনসহ মোট ৪০ জন সাক্ষী ৮ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন।
আসামিদের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা দু’জন মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন। পলাতক বাকি ছয়জন ছিলেন আলবদর বাহিনীর। গ্রেফতারকৃত অ্যাডভোকেট শামসুল আলম জামালপুর জেলা জামায়াতের সাবেক আমির এবং এস এম ইউসুফ আলী সাবেক জামায়াত নেতা ও সিংহজানি স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক।
মামলাটির প্রধান আসামি পলাতক আশরাফ হোসেন আলবদর বাহিনীর জামালপুর মহকুমা কমান্ডার ছিলেন। তার মাধ্যমেই মূলত ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। মামলাটি দায়েরের পর থেকেই তিনি ভারতে পালিয়ে আছেন বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
এছাড়া পলাতক অধ্যাপক শরীফ আহম্মেদ স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক এবং বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে গত ৩ মার্চ আশরাফ হোসেনসহ ওই আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-২। পরোয়ানা জারির পর ওই দিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে অভিযান চালিয়ে জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে শামসুল হককে ও ফুলবাড়িয়ার জাহেদা শফির মহিলা কলেজ গেট প্রাঙ্গণ থেকে ইউসুফ আলীকে গ্রেফতার পুলিশ।
আট আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ
আট আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে জামালপুরে রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন, স্থানীয় সাধনা ঔষধালয় দখল করে আলবদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির কার্যালয় স্থাপন এবং সিংহজানি হাইস্কুলে আলবদরদের প্রশিক্ষণ প্রদান। এছাড়া পিটিআই হোস্টেল ও আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রি হোস্টেল দখল করে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে সেগুলোতে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আসামি ইউসুফ আলী ও শামসুল হক তৎকালীন জামালপুর মহকুমায় ১০ হাজার লোককে হত্যা এবং ৭৫ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, মো. হারুন ও আব্দুল বারি ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই এবং ২২ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মইষ ভাদুরীয়া ও ধূপদহ গ্রামের শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারের বাড়ি, মো. সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বাড়ি, আমির আলী খানের বাড়ি, পিটিআই হোস্টেলের টর্চার ক্যাম্প, জামালপুর শ্মশানঘাটে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই রাত ৩টার দিকে আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারি, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী জামালপুরের সিঅ্যান্ডবি রোডের দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণের পর ওই দিনই তাকে হত্যা করেন।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারি জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজের নির্যাতন কেন্দ্রে আইয়ৃব আলী ফকিরকে আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করেন।
পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে জামালপুরের পিটিআই নির্যাতন কেন্দ্রে শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তার, সাইদুর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যান, শহীদ আব্দুল হামিদ খান ও স ম রেজাউল করিমকে আটক রেখে নির্যাতন করে হত্যা করেন আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারি, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
এএসআর