ঢাকা, শুক্রবার, ১০ মাঘ ১৪৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২৩ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

দেখার কেউ নেই শেরে বাংলার জন্মভিটা

রহিম রেজা, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
দেখার কেউ নেই শেরে বাংলার জন্মভিটা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঝালকাঠি: ২৬ অক্টোবর। ১৮৭৩ সালের এই দিনে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক শেরে বাংলা (বাংলার বাঘ) আবুল কাশেম ফজলুল হক।



এই মহান নেতা সব সময় মানুষের কল্যাণেই কাজ করেছেন। শোষণ ও নির্যাতন মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার আমৃত্যু সংগ্রাম। শিক্ষার প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ। এলাকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার কথা ভেবে ১৯৪১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাতুরিয়া এম এম হাই স্কুল। এই স্কুল এবং তার জন্মগৃহ এখন অবহেলায় পড়ে আছে। ফলে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এখানে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

সাতুরিয়া গ্রামের শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাসভবনটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই ঘোষণার চার বছর পার হলেও তা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অযত্ন আর অবহেলার মধ্যে রয়েছে এই নেতার বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ির স্থাপনাও।

`বাংলার বাঘ’ জন্ম নেন সাতুরিয়ায় তার নানা বাড়িতে। বাড়িটি ‘সাতুরিয়া মিয়াবাড়ি’ নামে পরিচিত। শেরে বাংলার শৈশব ও কৈশোরের কাটে এই গ্রামে। এখানকার একটি মক্তবে তিনি লেখাপড়া করেন। যে পুকুরে তিনি সাঁতার কাটতেন তা আজও আছে। এক সময় রাজনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল এই সাতুরিয়া।

মোঘল আমলে নির্মিত মহান এই নেতা যে ভবনে জন্ম নিয়েছিলেন, সেটির এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। দেয়ালের কোথাও কোথাও খসে পড়ছে ইট। প্রায় শোনা যায়, ভবনটির ছাদের পলেস্তরা ঝরে পড়ার শব্দ।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর একাধিক বার সাতুরিয়ায় এসেছিলেন ফজলুল হক। তার ছেলে প্রয়াত এ কে ফাইজুল হকও মন্ত্রী ছিলেন। তবে শেরে বাংলার জন্মভিটা ও সাতুরিয়া স্কুলের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি।

শের বাংলার জন্মভবনে এখন ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন তার উত্তরসূরীরা। স্কুলটিতে ঝুঁকি নিয়ে চলছে পাঠদান। বহুবার এই এলাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

যে রাজনীতিকের জন্য বাংলার কৃষকরা জমিদারদের শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, তার জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনেও বিভিন্ন মহলে রয়েছে অনাগ্রহ।

এলাকাবাসী জানান, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে শেরে বাংলার জন্মস্থানটিকে পর্যটন স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে।

পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর শেরে বাংলার জন্মভবনকে ১৯৬৮ সালের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ আইন (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণযোগ্য বিবেচিত হওয়ায় ভবনটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রত্নসম্পদ আইনের ১০ ধারা (১) উপ-ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার ১নং সাতুরিয়া মৌজার তিনটি খতিয়ান ও দাগের মোট দশমিক ৬১ একর জমি সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ বলে ঘোষণা করে।

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এ বিষয়ে ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। ২০১০ সালের ১৮ মার্চের গেজেটে তা প্রকাশিত হয়।

এরপর ওই জমির খতিয়ান, দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ ও মালিকানা স্বত্ব নিয়ে দু’জন ওয়ারিশ লিখিতভাবে আপত্তি জানালে জটিলতা দেখা দেয়। এ নিয়ে যাচাই-বাছাই কাজে চলে যায় দীর্ঘ সময়। বিষয়টি এখনও পুরোপুরি নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি।

শেরে বাংলার নিকটাত্মীয় নজরুল ইসলাম জানান, রাজনৈতিক উদ্দেশে গত সরকার শেরে বাংলাকে মূল্যায়ন করেনি। বর্তমান সময়েও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এর পিছনেও কোনো অদৃশ্য শক্তি থাকতে পারে।

সাতুরিয়া এম এম মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ফজলুল হক আকন বলেন, কোনো সরকারই মহান নেতার স্মৃতি সংরক্ষণে এগিয়ে আসেনি। শেরে বাংলার প্রতিষ্ঠিত এম এম হাই স্কুলে বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে ছয় শতাধিক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে, ফলফলও ভালো। কিন্তু স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নে নজর নেই কর্তৃপক্ষের।

তিনি বলেন, ১৯৬৭ সালে নির্মিত স্কুলের একটি ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভবনটি সংস্কারের জন্য একাধিকবার আবেদন করেও কোনো ফল হয়নি।

শেরে বাংলার জন্মভবনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন তার নিকটাত্মীয় হোসনে আরা বেগম বুলু ও তার পরিবারের সদস্যরা। সেটিরও কোনো সংস্কার বা উন্নয়নে ভূমিকা নেই-যোগ করেন শিক্ষক ফজলুল হক আকন।

এদিকে, ২০০৮ সালে ঝালকাঠি জেলা পরিষদ ‘শেরে বাংলা’ নামে একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এজন্য টাকাও বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় তা আলোর মুখ দেখেনি।

এছাড়া, সাতুরিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নসহ শেরে বাংলার নামে একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ, ডাক বাংলো ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠার দাবি এলাকাবাসীর বহুদিনের। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিশ্চুপ। যেন দেখার কেউ নেই।

রাজপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম সাদিকুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শেরে বাংলার জন্মস্থানের জমির তফসিল, জমির খতিয়ান, দাগ নম্বর ও জমির পরিমাণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সেসবের কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে। আশা করছি, খবু শিগগিরই শেরে বাংলার জন্মভবন ও জন্মভিটা সংরক্ষণের কাজ শুরু করা যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।