ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ মাঘ ১৪৩১, ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ২০ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

দুর্গম এলাকায় গুণগত শিক্ষার চ্যালেঞ্জ

ইসমাইল হোসেন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৫
দুর্গম এলাকায় গুণগত শিক্ষার চ্যালেঞ্জ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গোয়াইনঘাট (সিলেট) থেকে ফিরে: টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডায় (এসডিজি) একটি লক্ষ্যমাত্রা হলো অন্তর্ভূক্তিমূলক, সুষম ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ। দুর্গম এলাকায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রয়েছে আর্থ-সামজিক বৈষম্য ও শিক্ষা সুবিধার চ্যালেঞ্জ।

 

সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষা সুবিধার অভাব, সড়ক যোগাযোগ, অপ্রতুল শিক্ষক এবং অবকাঠামো সমস্যাগুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় সুষম শিক্ষা অর্জনের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডায় (এসডিজি) ৪ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় বলা হয়েছে, অন্তর্ভূক্তিমূলক, সুষম ও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।  

গোয়াইনঘাট উপজেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিছানাকান্দির পিয়ং নদীতে বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে ডুব দিচ্ছে শিশু-কিশোররা। ঝুড়ি ভরে তুলছে নুড়ি-পাথর। পানিতে পরিষ্কার করে ভরছে  নৌকায়। ইঞ্জিন চালিত একটি নৌকার সঙ্গে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরও ৪/৫টি। পাথর বোঝাই এসব নৌকা যাচ্ছে ঘাটে ঘাটে। সেখানে বিক্রি হচ্ছে পাথর।

দুর্গম বিছানাকান্দির পাথর তোলার এই চিত্র নিয়মিত দেখা যায় পাথর তোলার মৌসুমে। এখন এ দৃশ্য প্রতিদিনকার। আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে গোয়াইনঘাট উপজেলার শিশুরা এভাবে পাথর তোলার কাজেই ব্যস্ত থাকেন। আর যারা স্কুলে আসেন, বাড়িতে গিয়ে পড়ার জো নেই তাদের। কারণ একটাই- অতি শ্রেণি বৈষম্য।

পাথরে মনোযোগী শিশু শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেও অমনোযোগী। এর কারণ অতিরিক্ত শিক্ষার্থী এবং শাখা না থাকা।

রয়েছে শিশুদের দেরিতে ভর্তি ও আগাম ঝরে পড়া। এডুকেশন ওয়াচের ২০১০ সালের খানা জরিপে দেখা যায়, ৬ বছরের শিশুদের ভর্তির হার চাবাগান/পাহাড়/বনভূমি এলাকায় ৫২.৩ ভাগ, যেখানে জাতীয়ভাবে ৬৫ শতাংশ।

এডুকেশন ওয়াচের খানা  জরিপে দেখা যায়, গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোর এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক শহর এলাকায় বাস করেন।   গ্রামীণ সিলেটে দেরিতে উপস্থিতি এবং আগাম স্কুল ত্যাগের কারণে একজন শিক্ষক গড়ে ৬৬ মিনিট সময় নষ্ট করেন। আর চাবাবাগন/বনভূমি/পাহাড় এলাকায় এ সময় ৩৪ মিনিট।

বগাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসে গিয়ে দেখা গেল, ১৩০ জনের মধ্যে উপস্থিত ৮৭ জন। ক্লাসে হোম ওয়ার্ক করতে পারেনি কোন শিক্ষার্থী।

শিক্ষকরা বলেন, বাড়িতে কোন গাইডের ব্যবস্থা নেই। ক্লাসে যা পড়ে সেটাই ভরসা। বাড়িতে গিয়ে পড়ার ব্যবস্থা থাকলে এবং ক্লাসে সময় বেশি পেলে ভাল হতো।

পরিদর্শনের অভাবকেও শিক্ষার এ গুণগতমানের জন্য দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। ২০১০ সালের এডুকেশন ওয়াচের খানা জরিপে দেখা যায়, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার কর্তৃক পরিদর্শিত হয়নি এমন স্কুলের শতকরা হার গ্রামীণ সিলেটে ৭০.৮ শতাংশ।

বগাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০১৪ সালে সমাপনী পরীক্ষায় ৮৯ জনের মধ্যে সকলেই পাস করেছে। অথচ গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে এসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের।

বিছানাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে ৬৬ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল ৪৯ জন। এলোমেলো করে ম্যাংগো শব্দটি লিখে দিলেও বলতে পারেনি কোনো শিক্ষার্থী। এছাড়া জাতীয় দিবসগুলো সম্পর্কে দু’একজন ছাড়া জ্ঞান নেই শিক্ষার্থীদের।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফারজানা ফেরদৌসী বললেন, শিক্ষক স্বপ্লতা ছাড়াও অভিভাবকরা অসচেতন। ক্লাসে যা পড়াই তা ছাড়া শেখানোর উপায় নেই।

ভারপ্রাপ্ত উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাগত দিকটা ভাল। তবে এখন গুণগত মান বাড়াতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে পরিদর্শনের উপর জোর দিতে হবে। তবে সংখ্যা কম। সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ৬ জনের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেটে ভাসমান লোকসংখ্যা বেশি। এতে প্রাথমিক শিক্ষার উপর একটা প্রভাব পড়ে। ভর্তি হয়েও অনেকে চলে যায়। পাথর তোলার জন্য আসে এখানে। ফলে শিক্ষায় মনোযোগ থাকে না।

গুণগত মানের ঘাটতির কথা স্বীকার করলেন উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এখানে শ্রেণি বৈষম্য মারাত্মক। একশ’ জনের মধ্যে ৯৫ জন নিম্নবিত্ত।  

শিক্ষার মান নিয়ে বিভাগীয় উপ-পরিচালক তাহমিনা খাতুন বলেন, শিক্ষকরা আন্তরিক হলে মান বাড়বে। এজন্য মনিটরিং করা হয়। নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। সহকারী শিক্ষা অফিসারের নিয়োগের জন্য তারা বলেছেন।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

তবে দ্রুত শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মকর্তা নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান মহাপরিচালক।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০১৫
এমআইএইচ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।