ঢাকা: একই সম্প্রদায়ের লোকজন তারা। ভাষা সংস্কৃতি আচার-আচরণও এক, পার্থক্য শুধু একটাই, আর তা হলো দাবি।
অন্যপক্ষ নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিয়ে এদেশের নাগরিকের সব সুবিধা পেতে চান।
সম্প্রতি নিজেদের স্বকীয়তা তুলে ধরতে এমন দাবি নিয়ে রাজধানীতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকজন।
কর্মসূচিতে ঢাকার আশপাশে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ছাড়াও খুলনা, রাজশাহী, মাগুরা, যশোর, নড়াইল থেকে এ সম্প্রদায়ের লোকজন অংশ নিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রণয়ন ও রাজবংশীদের অন্তর্ভুক্তকরণসহ সব ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধার দাবিতে ৪ নভেম্বর (বুধবার) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ।
রাজবংশী সমাজ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উদ্যোগে আয়োজিত কর্মসূচিতে সহায়তা দেয় গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ (আরডিসি)।
কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর মেসবাহ কামালসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথি ছিলেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন। রাজবংশীদের দাবির সঙ্গে ঐক্যমত্য পোষণ করে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
রাজবংশী সম্প্রদায়ের নেতা ডা. সুভাষ রাজবংশী বাংলানিউজকে বলেন, রাজবংশী এদেশের একটি সুপ্রাচীন জাতি সত্ত্বা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের বসবাস রয়েছে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসকরাও তাদের কখনও আদিবাসী ও কখনও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কিংবা অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে সনদ দিয়েছেন।
তিনি জানান, রাজবংশীদের বর্মণ, বিশ্বাস, রায়, সরকার, মন্ডল, বাড়ই, মাঝি রাজবংশী, বৈদ্য, হালদার ইত্যাদি উপাধি রয়েছে। এরমধ্যে শুধু বর্মণদেরই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এ কারণে এ সম্প্রদায়ের অন্যান্যরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
‘জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম ও আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণা পত্রে রাজবংশীদের স্বতন্ত্র আদিবাসী/অনগ্রসর জাতিসত্ত্বার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাই স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি,’ যোগ করেন ডা. সুভাষ রাজবংশী।
এদিকে একই দিন নিজেদের মূল জাতিসত্ত্বায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ রাজবংশী ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশন।
সংগঠনটির সভাপতি সুরেশ চন্দ্র রাজবংশী বাংলানিউজকে বলেন, ২০১০ সালে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তালিকা থেকে রাজবংশী সম্প্রদায়কে বাদ দেওয়ার কথা বলা হলেও তা এখনও বহাল আছে। কিন্তু কিছু স্বার্থন্বেষী রাজবংশী সম্প্রদায়কে ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যা আমাদের জাতিসত্ত্বার জন্য হুমকি স্বরূপ।
‘আমরা ক্ষত্রিয়, আমরা বাঙালি, তাই মূল জাতি সত্ত্বায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাই। আলাদাভাবে আদিবাসী হয়ে থাকতে চাই না,’ বলেন তিনি।
বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাজবংশী বাংলাদেশে বসবাসরত একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের ক্ষত্রিয় নামক এক কোচ শাখার সঙ্গেও অভিন্ন বলে অনেকে মনে করেন।
দূরাতীত কালে হিমালয় অঞ্চল বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে আগত রাজবংশীরা খর্বকায়, চ্যাপ্টা নাক, উঁচু চোয়ালবিশিষ্ট এক মিশ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। এরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী।
বর্তমানে এদের কেউ কেউ মুসলমান, কেউবা খ্রিস্টান। বাংলাদেশে প্রধানত রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী এবং অতি অল্পসংখ্যায় বগুড়া ও ময়মনসিংহ জেলায় বসবাস রয়েছে।
১৯৪১ ও পরবর্তী আদমশুমারিতে রাজবংশীদের হিন্দু জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের মোট জনসংখ্যা পাঁচ হাজারের কিছু বেশি।
রাজবংশীরা মূলত কৃষিজীবী, তবে মাছধরা এবং মাছ বিক্রি তাদের অন্যতম পেশা। মেয়েরা কুটির শিল্পের কাজে দক্ষ।
ধর্মীয় আচারে তাদের শৈব বলে মনে করা হলেও শাক্ত, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক প্রভৃতি বিশ্বাসের সমন্বয়ে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে।
খরা, অনাবৃষ্টি উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ‘হুদুমা’ পূজা রাজবংশীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান।
রাজবংশীদের ভাষা স্থানিক তথা আঞ্চলিক ভাষার এক মিশ্ররূপ। তারা যে আঞ্চলিক মিশ্র ভাষায় কথা বলে তা কারও কারও বিচারে ‘বিকৃত’ বাংলা। রাজবংশীদের বিবাহ প্রথায় সাঁওতাল, ওরাওঁদের বিবাহরীতির প্রভাব যথেষ্ট।
মৃতদেহ পুড়িয়ে সৎকার কাজ সম্পন্ন করে রাজবংশীরা। একমাস পর মৃত ব্যক্তির জন্য শ্রাদ্ধকর্ম অনুষ্ঠিত হয় বলেও বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৫
এমএ/জেডএম