বরিশাল: কাউনিয়া মহাশশ্মানে সোমবার ও মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে বরিশালের শতবছরের ঐতিহ্যের স্মারক দিপালী উৎসব।
এ উৎসবকে ঘিরে ৫ একর ৪১ শতাংশ আয়তনের এ মহাশ্মশান আলোকিত হয়ে উঠবে।
প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশে তাদের সমাধি সৌধে দীপ জ্বালিয়ে দেওয়ার এই প্রথা উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে এখানে দিপালী উৎসব নামে উদযাপিতে হয়ে আসছে। সে কারণেই কাউনিয়া মহাশ্মশানের এই দিপালী উৎসবের প্রথা শতবছর ধরে চলছে বলা যায়।
প্রতিবছর এই দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মহাশ্মশানে সমবেত হন প্রয়াত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ করতে। সমাধির ওপর হাজার হাজার মোমবাতি জ্বালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করবে। তাদের স্বর্গীয় আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করা হবে।
সমাধি সৌধে শুধুমাত্র দীপ জ্বালানোই হয় না, মৃত ব্যক্তির ছবি ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় সমাধির উপর। প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে খাবার-দাবারও দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ধূপ, ধুপকাঠি জ্বেলে দেওয়া হয়। কেউ কেউ আবার ধর্মীয় গান ও খোল বাদ্য সহকারে কীর্তন করেন প্রিয়জনের আত্মার সন্তুষ্টির জন্য।
দিপালী উৎসবের লক্ষে মহাশ্মশান রক্ষা সমিতি দুদিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রতিবছর শ্মশান দিপালী উৎসবে, সমাধি সৌধে দীপ জ্বেলে দেবার পর আলোর রশ্মিতে ভরে ওঠে মহাশ্মশান। এই উৎসব দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটকও এসময় বরিশালে আসেন। তাদের কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের স্মৃতির উদ্দেশে দীপ জ্বেলে দেয়।
এদিকে, এ উৎসবকে ঘিরে দেশ-বিদেশের মানুষ আসতে শুরু করায় ইতোমধ্যে বরিশালের হোটেলগুলো বুকিং হয়ে গেছে। শ্মশান ও এর আশপাশের এলাকায় বাড়ছে মানুষের পদচারণা। বসানো হয়েছে শ্মশান ঘাট এলাকায় মেলা। সেখানে এবারেও থাকছে ৩৫ টির মতো স্টল।
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা জানান, এবার মহাশ্মশানে দিপালীতে লাখো মানুষের সমাগম ঘটবে। সমাধি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ ইতোমধ্যে শেষের পথে।
গত ৭ দিন ধরে চলছে রঙ, মাটি দেওয়া ও ইট-পাথরের খুঁটিনাটি মেরামতের কাজ। এসব কাজে শতাধিক শ্রমিক এখানে কাজ করে চলছেন। পাশাপাশি শ্মশান এলাকাজুড়ে আলোকসজ্জার কাজও শেষের পথে। এবারে প্রথম বারের মতো ২৫টি লাইটপোস্ট বসিয়ে আলোকসজ্জায় নতুনত্ব আনার কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন।
দিপালীর পরের দিনই হবে কালি পূজা।
বরিশাল মহাশ্মশানের রক্ষা সমিতির সভাপতি মানিক মুখার্জি কুণ্ডু বাংলানিউজকে জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে থেকে মঙ্গলবার রাত ৯টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ভূত চতুর্দ্দশী পুণ্য তিথিতে দুদিনব্যাপী উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী দিপালী উৎসব এবং মঙ্গলবার রাত ১২টা ১মিনিটে শ্রীশ্রী কালীপূজা কাউনিয়াস্থ বরিশাল মহাশ্মশানে ও নতুন বাজারস্থ অমৃতাঙ্গনে (আদি শ্মশানে) অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে, দিপালী উৎসবের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। নিরাপত্তার দায়িত্বে পোশাকধারী র্যাব-পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উৎসব এলাকায় মোতায়েন করা হবে বলে জানা গেছে।
এছারা শ্মশানে আগতদের সেবা প্রদানে নিয়োজিত থাকছেন দেড়শ’ স্বেচ্ছাসেবক।
বরিশাল মহাশ্মশান রক্ষা সমিতির পরিচালনায়, সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় শ্মশানের যাবতীয় উন্নয়ন, কার্যক্রম সৌন্দর্যবর্ধন ও ঐতিহ্যবাহী শ্মশান দিপালী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নারায়ন চন্দ্র নারু জানিয়েছেন, এখানে পাকা সমাধি রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ৯ শতাধিক সমাধি রয়েছে যাদের কোনো স্বজন নেই। এ ধরনের শ্মশানকে নির্দিষ্ট রঙ দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব সমাধিতে হয়তো কোনো দিন কেউ ফুল দেবে না। তবুও শ্মশান দিপালী উৎসবে দীপ জ্বেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্মশানের রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে। মানুষ মরে গেলে স্মৃতি ধরে রাখার এই চেষ্টার মধ্য দিয়েই রয়েছে পূর্বসূরীর প্রতি উত্তর প্রজন্মের বিনম্র শ্রদ্ধা।
তিনি জানান, পাশাপাশি এ শ্মশানে প্রতি বছরে প্রায় ৩০০ মৃতদেহ দাহ করা হয়।
শ্মশান সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, মৃত্যুর ৮০ বছর পর তিন’বছর আগে ভারতের কেওড়াতলা মহাশ্মশান থেকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের চিতাভস্ম এনে এ মহামশ্মশানে স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও এ মহাশ্মশানে রয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ, মনোরমা বসু মাসিমা, রাজনীতিবিদ শরৎচন্দ্র গুহ, শিক্ষাবিদ কালি চন্দ্র ঘোষ, ভাষা সৈনিক রাণী ভট্টাচার্য, জঙ্গীদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত জজ জগন্নাথ পাঁড়ে, চারুশিল্পী বলহরি সাহা, শ্যামপুরের জমিদার কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী (নাটু বাবু), কবি রবীন সমাদ্দার, সাংবাদিক আইনজীবী মিহির লাল দত্ত, রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশের বাবা সত্যানন্দা দাশ ও পিতামহ সর্বানন্দা দাশসহ বিভিন্ন ক্ষ্যাতনামা ব্যক্তিদের সমাধি।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০১৫
পিসি/