স্টেডিয়াম থেকে ফিরে: স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় মুশফিকুর রহিমের অর্ধশত রানের স্কোরটা ভেসে উঠা মাত্র চারদিক মুশফিক ধ্বনিতে মুখরিত হলো। উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর রকমারি শব্দের ভিড়ে মিহি এক বাশের বাঁশির সুর ছুঁয়ে গেলো কান।
সেই সুরের উৎস খুঁজতেই পাওয়া গেলো ৬৬ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে। গায়ে লাল রংয়ের নবাবী ঢংয়ের পোশাক, মাথায় টুপি, বুকে সাঁটানো তরবারি, পায়ে নাগড়া ও মাথার ওপরে বিশালাকৃতির ছাতা। আর হাত আছে লম্বা এক বাশের বাঁশি।
বৃদ্ধের সঙ্গে তরবারি ও বাঁশি দেখে কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার বিখ্যাত পঙক্তি- 'মম এক হাতে বাঁকা বাশের বাঁশরী আর হতে রণ-তূর্য'র মতো অপূর্ব সম্মিলন লক্ষ্য করা গেলো। যেন বিষয়টা এমন- ক্রিকেট মাঠে যুদ্ধ হবে, আর বাঁশির সুরে সুরে গড়ে উঠবে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব।
ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে বৃদ্ধের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা সিরাজদ্দৌলা।
পরক্ষণেই হাসি মাখা মুখে প্রমিত উচ্চারণে তিনি হরহর করে বললেন, ‘আমার নাম আলা উদ্দিন খাঁ। ১৯৪৯ সালে কুষ্টিয়ার রামকৃষ্ণ ইউনিয়নে আমার জন্ম। ৯ বছর বয়সেই বাবার কাছে বাঁশি বাজানোর তালিম নিই। তরপর থেকে সেই বাঁশি আমার সঙ্গী। বাঁশি বাজিয়েই কাটলো ৫৭টা বছর।
বিনিময়ে কী পেলেন এমন প্রশ্নের তৎক্ষণাত উত্তর- ‘শুধু ভালোবাসা’।
‘আমার এলাকার সবাই আমাকে বংশীবাদক হিসেবে চেনে। যেখানে যাই সেখানেই মানুষকে আনন্দ বিলাই, আর কী চাই এক জীবনে?’-বললেন তিনি।
বংশীবাদক আলা উদ্দিন খার শৈশব-কৈশোর কেটেছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। পরবর্তীতে রাজধানীর মিরপুর-১১ এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। সেখানেই তার বর্তমান বসবাস। সংসারের ঝুট-ঝামেলা সব দুই ছেলেকে দিয়ে এখন তিনি ক্রিকেট আর বাঁশি নিয়েই আছেন।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি তার গভীর ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার টানেই তিনি আপন খেয়ালে নিজের স্বাদ-আহ্লাদ পূরণ করার চেষ্টা করেন।
আলা উদ্দিন ছোটবেলায় বাঁশির ভক্ত হলেও বড়বেলায় এসে বাঁশির পাশাপাশি হয়েছেন ক্রিকেট ভক্ত। তাই মনের আনন্দে দেশের ভেতরে বাংলাদেশের যে স্টেডিয়ামেই খেলা হোক না কেন, টাইগারদের অনুপ্রেরণা দিতে সেখানেই যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ঢাকার কোনো খেলা তিনি মিস করেন না।
কয়েক বছর আগে প্রথম দিকে তাকে স্টেডিয়ামে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়েছে। তার এই ক্রিকেট পাগলামি দেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তার টিকিট ফ্রি করে দিয়েছে। স্টেডিয়ামের প্রায় সব গ্যালারি ঘুরে এখন তিনি মনের আনন্দে বাঁশি বাজিয়ে আনন্দ ফেরি করেন।
এই ক্রিকেট প্রীতির জন্য তার স্ত্রী প্রায়ই ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু বড় ছেলের উৎসাহে তিনি ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আর আজন্ম বন্ধন ধরে রাখতে পেরেছেন। গ্যালারিতে বাঘের সাজে ক্রিকেট ভক্ত টাইগার মিলন ও টাইগার শয়েবের মতো আলা উদ্দিনের সিরাজী সাজ ও রঙ ঢং বেশ উপভোগ্যময় হয়ে উঠেছে। যারা নিয়মিত স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যান, তারা প্রায় সবাই এদের চেনেন।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আলা উদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, ‘একাত্তর সালে যখন যুদ্ধ করেছিলাম, তখন প্রাণ হারনোর ভয় ছিল। কিন্তু ক্রিকেট মাঠের যুদ্ধে রক্ত ক্ষয় নেই, প্রাণ হারানোর ভয় নেই, আছে শুধু উচ্ছ্বাস আর আনন্দ। ’
সেই উচ্ছ্বাস দর্শকদের আরো বেড়ে যায়, যখন সশরীরে মাঠে উপস্থিত থেকে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচ অডিআই সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৪৫ রানের বিশাল ব্যবধানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার সুযোগ হয়।
মানুষ প্রতিনিয়তই ভুলে যায়। ভুলে যাওয়াটাই যেন মস্তিস্কের ধর্ম। প্রাণ-আরএফএল’র সৌজন্যে পাওয়া টিকিটে শনিবার (০৭ নভেম্বর) মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নব্য সিরাজউদ্দৌলার সুরেলা ক্রিকেটীয় স্মৃতি কী ভুলে যাওয়া সম্ভব..!
বাংলাদেশ সময়: ০২২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৫
টিআই/এসএইচ