২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে দমন-পীড়ন শুরু হলে গত দুই মাসে প্রায় ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
আরও পড়ুন>>
** এত রোহিঙ্গা শিশুর ভবিষ্যৎ কি ?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার অভাবে রোহিঙ্গারা তেমন সচেতন নয়। প্রত্যেকের পরিবারেই গড়ে ৫ থেকে ১০ জন সন্তান-সন্ততি রয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ বিষয়েও তাদের সচেতনতা কম। তাদের ধারণা, বেশি সন্তান নিতে পারলে খাবার সংগ্রহ করাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ নারীর কোলেই একজন করে শিশু। প্রতিটি ঘরেই ৫-৬ জন থেকে ১১ জন পর্যন্ত শিশু আছে। রোহিঙ্গা নারীরা কাউকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। জ্বর, কাশিসহ বিভিন্ন অসুখে ভুগছে অনেক শিশু। প্রতিটি ঘরে নবজাতকের কান্না। ।
মিয়ানমারের মংডু জেলার ভুদাইসন থেকে আসা হালিমা বেগমের ৮ সন্তান। এরমধ্যে সবচেয়ে ছোট হারেসের বয়স ১০ মাস। ওমরের বয়স ২ বছর ও রফিকের বয়স ৩ বছর। বাকিদের বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে।
হালিমা বাংলানিউজকে বলেন, তিনটা এখনও কোলের বাচ্চা। বাকিরা বাইরে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করছে। ভিক্ষা করেও খেতে পারছে।
উখিয়ার কুতুপালং পুরান রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমন এক নারীকে পাওয়া গেছে, যার ১৫ জন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। রোজেনা বেগম নামে পঞ্চাশ বছর বয়সী ওই মা বলেন, এতো বেশি সন্তান-সন্ততি থাকলেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
সরেজমিনে দেখা যায়, উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প ছাড়াও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে রোহিঙ্গা শিশুরা। যাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১০ বছরের কম। এর মধ্যে ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে কারও শিশু পাহাড়ে গিয়ে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করছে, কেউ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করছে। অনেকেই আবার ত্রাণ সংগ্রহসহ বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে সহযোগিতা করছে।
বিষয়টি নজরে আনলে কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য্য বলেন, নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মবিরতিকরণের পদ্ধতি চালু করতে কাজ করছে সরকার। এবার নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হলে সেই কার্যক্রমে আবারও গতি আনা হয়।
‘তারা (রোহিঙ্গা) খুবই পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী। তাদের মধ্যে একাধিক বিয়ের প্রবণতা ছাড়াও অধিক সন্তান-সন্ততি নেওয়ার প্রবণতাও বেশি। ’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বাস্থ্যসেবা কাজে জড়িত কর্মীরা জানান, রোহিঙ্গারা যৌন মিলনের সময় কোনো ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে রাজি নন। গত দুইমাস ধরে অনেক চেষ্টার পর মাত্র সাড়ে ৫০০ প্যাকেট কনডম বিতরণ করা হয়েছে। তবে তা-ও ব্যবহারেও অনীহা রয়েছে তাদের।
এই পরিস্থিতিতে পুরুষদের জন্য স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ভ্যাসেকটমি আর নারীদের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি টিউবেকটমি চালু করতে সরকার কাজ শুরু করেছে বলে জানান ডা. পিন্টু।
স্থানীয় জেলা প্রশাসন ও ত্রাণকর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এমনিতেই মানুষের সংখ্যা বেশি। আর নতুন শিশুর জন্ম হতে থাকলে তা আরও বেড়ে গিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। তবে শরণার্থী ক্যাম্পে তাদের টিকে থাকার বেশি মানুষ দরকার বলে মনে করেন রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের আকিয়াব জেলার বুথিডং এলাকার তুলাতুলি পাড়া থেকে কুতুপালং নতুন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া সাইফুল্লাহ (৫০) বাংলানিউজকে বলেন, ছেলে-মেয়ে সবাই কাজ করতো তার সঙ্গে। তাই কখনও বোঝা মনে হয়নি।
অনেক রোহিঙ্গা বলেন, বেশি সন্তান থাকলে নিত্যকার লড়াই চালাতে সুবিধা হয়। খাবার ও পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বেশি করে তা সংগ্রহ করা যায়।
আবার কেউ কেউ মনে করেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ ইসলাম-সম্মত নয়। এটা পাপের চোখেও দেখেন অনেক নারী-পুরুষ।
সাইফুল্লাহ জানান, মিয়ানমারে তারা কখনও হাসপাতালে যান না। মাঝে মাঝে গেলেও ওষুধপত্র দেওয়া হয় না। তাই অনেক সময় ছেলে-মেয়েরা রোগে-শোকে ছোটবেলাতেই মারা যায়।
আরও পড়ুন>>
** বাংলাদেশে এলো ২৩৪৮৭ এতিম রোহিঙ্গা শিশু
এ ছাড়া কোনো ধরনের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কথা তিনি শুনেননি বলে জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নারী-শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের কর্মী তাসলিমা রহমান বলেন, আমরা বিষয়টি তাদের বোঝাই। কিন্তু অনেক নারী বলেন- জন্মনিয়ন্ত্রণ একটি পাপ কাজ।
‘কেউ কেউ জানিয়েছেন- রাখাইনে তারা কোনো হাসপাতালে যান না। তাদের ধারণা গেলে মিয়ানমার সরকার ওষুধ দিয়ে ছেলে-মেয়েদের ক্ষতি করতে পারে। ’
কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু তাহের বলেন, অসুখ হলে ওষুধ খেতে হয়। আবার অসুখ না হওয়ার জন্যও যে ওষুধ খেতে হয়, তা তারা জানে না।
সূত্র মতে, গত চারবছর ধরে নিজে দেশের নাগরিকদের ভ্যাসেকটমি ও কিউবেকটমি সেবা দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ ব্যবস্থা গ্রহণকারীদের কিছু প্রণোদনাও দিয়ে থাকে সরকার।
এবার এ ব্যবস্থা রোহিঙ্গাদের ওপরও প্রয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১২০৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৭
এমএ/এইচএ/