ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন ভোলার দৌলতখানের মেঘনা তীরের বাঁধে আশ্রিত লাইজু বেগম। তার স্বামী জামাল হোসেন পেশায় জেলে, তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
এক সময় ঘর-ভিটা সবই ছিলো লাইজুদের, চারবার নদীভাঙনের পর এখন কিছুই নেই। এর ওপরে এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধের দুশ্চিন্তা জেঁকে বসেছে পরিবারটির মাঝে।
‘আমাদের কপালে ভালো খাবার জোটে না। ঋণ শোধেই সব শেষ হয়ে যায়’- বলছিলেন লাইজু।
মেঘনার কোলঘেঁষা বিপন্ন জনপদ উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের জেলেপল্লীর বাসিন্দা এই লাইজু। বাঁধের দুই পাশের গ্রামটিতে ঝুঁপড়ি ঘরে বসতি সেখানকার ৫ শতাধিক বাসিন্দার। তীর ঘেঁষেই ঘড়ে উঠেছে এসব ছোট ছোট ঘর। মেঘনার ছোবলে কিছুদিন পর পরই তাদের ঠিকানা পাল্টাতে হয়, উঠে আসতে হয় বাঁধের ওপরে।
তবে আজন্ম নদীর তীরেই থাকেন এই মানুষেরা, যেখানে নদীর শব্দের সঙ্গেই কাটে দিন। তবে সহায়-সম্বল হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করা এসব জেলে পরিবারগুলোকে ভাঙনের চেয়েও বেশি ভোগায় এনজিও’র ঋণ!
বিশেষ করে এসব পরিবারের গৃহবধূরাই এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চরম সংকটে পড়ে যান। কারণ, দারিদ্র্য বিমোচন-ভাগ্য উন্নয়নের কথা বলে নারীদেরকেই বেশিরভাগ ঋণ দেয় এনজিওগুলো।
দ্বীপজেলা ভোলার চারপাশ নদীবেষ্টিত হওয়ায় উপকূলবাসীকে রক্ষায় বাঁধ নির্মিত হয়। অথচ সেই বাঁধেই বাস করতে বাধ্য হন নদীভাঙনে ভূমিহীন, অসহায়, দুস্থ ও ছিন্নমূলে পরিণত হওয়া মানুষেরা। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্যানিটেশনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব পরিবার।
সরেজমিনে গেলে বাঁধে আশ্রিত জেলেবধূ হাসনুর, তাসলিমা ও রোকেয়া ছাড়াও ইউনুস, ইব্রাহিমসহ অনেক জেলে জানান, তাদের সবারই একই অবস্থা। হাজারো সমস্যা, চরম সংকট, অভাব-অনটন আর অনিশ্চয়তায় দিনের পর দিন আর বছরের পর বছর প্রজম্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দেন তারা। তবুও কাটে না তাদের সংকট, পরিশোধ হয় না এনজিও’র ঋণও!
হতদরিদ্র ওই মানুষেরা জানান, সংকট কাটাতে ঋণ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তাদের। কিন্তু ঋণের টাকায় সাময়িকভাবে উপকৃত হলেও তা পরিশোধ নিয়ে আজীবন চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হয়। অনেক সময় ঘরের টিন-আসবাবপত্র বিক্রি করলেও সুদে বাড়তে থাকা ঋণের কিস্তি বা পুরো টাকা মেলানো যায় না।
বাধ্য হয়ে অনেকেই এক এনজিও’র ঋণ শোধান অন্য এনজিও থেকে টাকা এনে। এভাবেই ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে সারাজীবন যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় গৃহবধূ নাহারও। তিনি বলেন, ‘স্বামী সিরাজ নদীতে মাছ ধরে। এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ঘর মেরামত করেছি। ওই ঋণ এখনও পরিশোধ করতে পারছি না। ৫ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভাত খাওয়ার পয়সাও জোটে না!’
‘চেয়ারম্যান-মেম্বারও আমাদের খোঁজ নেন না। যদি কোনো সাহায্য মেলে, তাও আমাদের ভাগ্যে জোটে না। ওদিকে আবার দমার শব্দ, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না’।
গৃহবধূ সামসুন বলেন, ‘২৪ ঘন্টাই দমার শব্দ, বাতাস বেশি হলে ঘর কেঁপে ওঠে। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার কেউ নেই। তাই এনজিও’র ঋণ ছাড়া কোনো উপায় নেই’।
গৃহবধূ মরিয়ম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারি না। তাই ঋণ নেই। কিন্তু সারা জীবন সেই ঋণের দায় নিয়ে কাটাতে হয়, কখনোই শোধ হয় না’।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১৭
এএসআর