শ্রমিকদের মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়ে যারা রাতারাতি ধনকুবের বনে যাচ্ছে তারা সব সময়ই রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে কোনোভাবেই অবৈধ পাথর উত্তোলন ও প্রাণহানি রোধ করতে পারছে না প্রশাসন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৪ মাসে পাথর তুলতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৫৮ শ্রমিক। এর মধ্যে চলতি বছরে ১০ জন মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম।
জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, কালাইরাগ ও ১০ নম্বর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আমজদ আর যুবলীগ নেতা শামীম আহমদ। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আলী আমজদের নিয়ন্ত্রণে থাকা কোয়ারির গর্তেই প্রাণ হারান ৫ শ্রমিক। এ ঘটনায় থানায় আলী আমজদকেও আসামি করে মামলা হয়।
গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছানাকান্দি ও শ্রীপুর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর। কানাইঘাটের লোভাছড়া নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মোস্তাক আহমদ পলাশ।
কোয়ারিগুলোর নিয়ন্ত্রক হওয়ার পরও এসব ‘গডফাদার’দের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। অবশ্য জৈন্তাপুরের শ্রীপুর কোয়ারির আধিপত্য নিয়ে হত্যা মামলায় কারাগারে আছেন লিয়াকত আলী। শামীমের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতরে মামলা থাকলেও কেবল মোস্তাকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
অবৈধ পাথর উত্তোলনের অভিযোগ অস্বীকার করে যুবলীগ নেতা শামীম আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, প্রশাসন টাকা খায়, আর দোষ আমার এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর। চার বছর আগে থেকে মামলায় ‘ফাঁসিয়ে’উপজেলা প্রশাসন কোয়ারি থেকে খাস কালেকশন করছে।
তার দাবি, ভোলাগঞ্জ কোয়ারি থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা খাস কালেকশন করলেও সরকারি কোষাগারে এর অর্ধেকও জমা দেওয়া হয় না। বাকি সব টাকা উপজেলা ও পুলিশ লুটে খাচ্ছে।
তবে সম্প্রতি শাহ আরেফিন টিলায় নিহত ৫ শ্রমিক উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলী আমজদের কোয়ারিতে মারা যান-নিশ্চিত করেন তিনি।
এ ব্যাপারে কানাইঘাট লোভাছড়া কোয়ারির নিয়ন্ত্রক মোস্তাক আহমদ পলাশের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া আলী আমজদ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলায় পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাথর খেকোদের এই অবৈধ অর্থের ‘ধান্ধা’ টিকিয়ে রাখতে তাদের রক্ষাকবজ হয়ে কাজ করছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি-এমনকি ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় গুটিকয়েক নেতা। স্বার্থের কারণে সেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই এক।
দলীয় প্রভাবের কারণে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ পরিবেশবাদীদের। পাথর তোলার এই অবৈধ ব্যবসা চালু রাখতে পরিবেশ অধিদপ্তর, আর পুলিশকে প্রতি মাসে বড় অঙ্কের চাঁদা দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা- এমন অভিযোগও আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা ট্র্যাজেডির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের তদন্তে ৪৭ জনের নাম উঠে আসে। মামলাও হয়। কিন্তু পাথর উত্তোলনকারী কর্তাদের একদিনও জেলে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। টাকার বিনিময়নে তারা প্রশাসনকেও কিনে রেখেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া সিলেটে পাহাড় টিলা কাটায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই গোপনে পাথর উত্তোলন করছে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ অধিদফতরের সিলেটের পরিচালক সালাহ উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, সিলেটে লিজ কোয়ারি লোভাছড়া, উৎমা ও শ্রীপুর ছাড়া অন্যগুলোর পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু যে যার মতো লুকিয়ে পাথর উত্তোলন করছে।
শাহ আরেফিন টিলা ট্র্যাজেডির ঘটনায় মামলার কথা উল্লেখ করলেও কাজের অগ্রগতির পেছনে লোকবল সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সন্দ্বীপ কুমার সিংহ বাংলানিউজকে বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধে কি ধরনের কার্যক্রম চালানো হয়েছে, পাথরখেকোদের তালিকায় কারা আছে-এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৮
এনইউ/আরআর