উত্তর, না! আসলেই কেউ ধারনা করতে পারবে না! এমনিতেই সাজানো গোছানো ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর দেশ জাপান। সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে পাহাড়-পর্বতে ঘেরা পুরো দেশটাই যেন একটা গোছানো বাগান।
এমন একটি দেশে অলিম্পিক হওয়া মানেই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেওয়া। স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে হোটেল-মোটেল, খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের আবাসিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, রাস্তা-ঘাট, ট্রেন-বাস, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো আবার নতুন করে সাজানো হচ্ছে।
প্রশ্ন জাগতে পারে মনে, আগে থেকেই তো সাজানো-গোছানো। নতুন করে আর কী সাজাবে। আমি বলবো, এগুলোকে পুনরায় একটু চেক করে নিচ্ছে! পুরনো রঙিন বাতির স্থলে নতুন লাগাচ্ছে আর কি! রাস্তা-ঘাট, শপিং সেন্টার, পার্ক-বিনোদন কেন্দ্র বা স্টেশনগুলোর ভেতরে বাইরে যে ডিজাইন আছে তাতেও একটু-আধটু করে হাত বুলিয়ে নিচ্ছে জাপানিরা। সারা বিশ্বের মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে লজ্জিত হওয়ার মতো জাতি যে জাপান নয়। তাই হয়তো বাড়তি সতর্কতা।
বাড়তি শ্রম আর বাড়তি অর্থ খরচ করছে জাপান সরকার। সাধারণ মানুষও সচেতন কম নয়। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া কোথাও একটি কাগজের টুকরাও ফেলে না। থু থু এলেও টিস্যু পেপার ব্যবহার করে তা পকেটে রাখে। তাদের সততা, ভদ্রতা, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা আর পরিশ্রমের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।
অলিম্পিকে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সত্যি বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে প্রস্তুত হচ্ছে জাপান। ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় অলিম্পিকের প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেছে দেশটির সরকার।
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহর টোকিওতে হবে অলিম্পিকের উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরও এটি। দেশি-বিদেশি মিলে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস এ শহরে। এতো মানুষের বাস, এরপরও শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র কোথাও ঘাটতি নেই।
ইতোমধ্যে জাপানের জাতীয় স্টেডিয়ামসহ বেশ কয়েকটি স্টেডিয়াম নতুন করে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। স্টেডিয়ামগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে জাতীয় স্টেডিয়াম নির্মাণে। সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর এ স্টেডিয়ামটিতে এক সঙ্গে বেশ কয়েকটি খেলা উপভোগ করতে পারবেন দর্শকরা। একটি স্টেডিয়ামে এতো রকমের প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়! এটি চোখে দেখেও শেষ করা সম্ভব নয়! স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারা দর্শকদের জন্য বাইরে থাকবে অত্যাধুনিক এইচডি কোয়ালিটির অসংখ্য এলইডি স্ক্রিন। অলিম্পিকের চিত্র ধারণেও থাকবে বিশ্বের সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের ক্যামেরা। জাপানি প্রযুক্তির ৩২ থেকে ৪০ মেগাপিক্সেল পর্যন্ত হবে এসবের ক্ষমতা।
১৯৬৪ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজক দেশ জাপান। জাপান অলিম্পিক কমিটির তথ্যানুযায়ী, ২০৬টি দেশের ৩২৪টি ইভেন্টে ১২ হাজারের বেশি খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করবে। জনপ্রিয় ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হবে জাপানের ৭টি বড় স্টেডিয়ামে। এর মধ্যে রয়েছে টোকিও জাতীয় স্টেডিয়াম, ইউকোহামা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম, সাইতামা স্টেডিয়াম, মিয়াগি স্টেডিয়াম, টোকিও আজিনোমতো স্টেডিয়াম, ইবারাকিরকাসিমা সক্কার স্টেডিয়াম ও সাপ্পোরো ডমে স্টেডিয়াম।
কমিটি জানায়, টোকিও সিটি গভর্নমেন্ট অলিম্পিক আয়োজনে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ইয়েন অর্থ খরচ করছে। এসবের মধ্যে বেশি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে স্টেডিয়াম সংস্কার, টোকিওর প্রাণকেন্দ্র ওদায়বায় সাগর পাড়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ নির্মাণ, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, রেলওয়ে সংস্কার, স্টেশনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, বড় বড় হাইওয়ে রোড সংস্কারসহ সিটি এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন, বর্ধিতকরণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ব্যয় হচ্ছে। টোকিও এবং এর আশপাশের সিটিগুলোতেই অধিকাংশ ইভেন্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জাপান। চলতি বছরের মধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হবে বলে জানিয়েছেন টোকিও সিটির গভর্নর ইউরেকো কেইকে।
সাগর পাড়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ
সত্যি অসাধারণ এক লোকেশনে তৈরি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বিলাসবহুল অলিম্পিক ভিলেজ। সাগরের পাড় কিছুটা ভরাট করে বিশাল জায়গাজুড়ে টোকিও সিটির সবচেয়ে দর্শনীয় ও আন্তর্জাতিক হোটেল-মোটেল সমৃদ্ধ স্থান ওদায়বার হারুমি চো-কোতে গড়ে তোলা হচ্ছে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল এ অলিম্পিক ভিলেজ।
কী নেই এ ভিলেজে! পাঁচতারকা হোটেলের সব সুবিধা থাকবে খেলোয়াড়দের আবাসিক এ ভিলেজে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ ভিলেজ তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। এ বছরেই পুরোপুরি প্রস্তুত হবে খেলোয়াড়দের এ ভিলেজ। এখানে থাকবে প্রায় ৭ হাজারের বেশি ইউনিট। এর পাশেই রয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত হারুমিফোতো পার্ক ও সমুদ্র সৈকত।
যেসব প্রযুক্তি থাকছে অলিম্পিকে
জাপানের টোকিও-ই প্রথম এশীয় নগরী; যেখানে ১৯৬৪ সালের পর দ্বিতীয়বারের মতো অলিম্পিক গেমস আয়োজন হতে যাচ্ছে। এ অলিম্পিকের অর্থনৈতিক মূল্য তিন ট্রিলিয়ন ইয়েনের বেশি।
টোকিও ২০২০ অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে এইট কে প্রযুক্তি। ২০২০ অলিম্পিক সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। এখানে হাইব্রিড ব্রডকাস্ট সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। ফেইসবুক বা টুইটারে সরাসরি কমেন্টস ও টুইটও করা যাবে। বিগ সাইট ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টার থেকে সারা পৃথিবীতে এ খেলা সম্প্রচারের আয়োজন করা হচ্ছে।
প্রতিটি খেলার স্কোর ও বিস্তারিত তথ্য স্পষ্টভাবে স্ক্রিনে দেখানো হবে। প্রতিটি ইভেন্টেই সর্বনিম্ন ৩২ মেগাপিক্সেল ক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে। আর ক্যামেরাটি অনেক বেশি সংবেদনশীল। থাকবে সাইন-ল্যাংগুয়েজেরও ব্যবস্থাও।
টোকিও অলিম্পিকে নতুন পাঁচ ইভেন্ট
রিও অলিম্পিকের পর জাপানের অলিম্পিক আসরে নতুন করে আরও পাঁচটি ইভেন্ট যোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। নতুন এ ইভেন্টগুলোতে থাকছে বেসবল, কারাতে, স্কেটবোর্ড, স্পোর্টস ক্লাইম্বিং ও সার্ফিং।
মুসলিমদের জন্য থাকছে ভ্রাম্যমাণ মসজিদ
অলিম্পিক আয়োজনকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুসলিম খেলোয়াড় ও দর্শকদের জন্য টোকিওর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ মসজিদ তৈরির কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেল ও বাস স্টেশনগুলোতেও মসজিদ বা প্রেয়ার রোম খোলা হয়েছে। টোকিও সিটির বেশকিছু বড় স্টেশন ও বিমানবন্দরগুলোতে স্থায়ী প্রেয়ার রোম বা মসজিদ চালু করেছে জাপান। রয়েছে হালাল সপ ও হালাল রেস্টুরেন্ট।
২০২০ টোকিও অলিম্পিকের মাসকট ঘোষণা
২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিকের মাসকট ঘোষণা করা হয়েছে। জাপান এবং বিদেশের প্রায় ১৬ হাজার প্রাথমিক স্কুলের শিশুরা বিশেষজ্ঞদের এক প্যানেল মনোনীত তিনটি মাসকটের মধ্য থেকে একটি বেছে নেওয়ার জন্য ভোট দেয়।
গত বুধবার টোকিওর একটি প্রাথমিক স্কুলে ২০২০ সালের অলিম্পিক ক্রীড়ার আয়োজকরা ওই ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। স্কুলটিতে সমবেত সাড়ে ৫০০ শিক্ষার্থী ফলাফল শুনে উল্লাস প্রকাশ করে।
বিজয়ী মাসকটটি হল চেক পোশাক আচ্ছাদিত মানব সদৃশ এক জোড়া রোবট। অলিম্পিক ক্রীড়ার আনুষ্ঠানিক প্রতীকেও এই একই ছবি রয়েছে।
উল্লেখ্য, তুরস্কের ইস্তাম্বুলকে হারিয়ে ২০২০ সালের অলিম্পিকের আয়োজক হওয়ার সম্মান অর্জন করে টোকিও। ওই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরটি বসবে সূর্যোদয়ের এ দেশে ।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক। ইমেইল:masum86cu@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৮
এমএ