তবে সেই সুখ বেশি দিন কপালে টিকেনি শিবুবালার। অনেক আগেই ছেলের বউয়ের বিরাগভজনে পরিণত হয়ে মারধরের শিকার হন তিনি।
সম্প্রতি তাকে নিয়ে ছেলে আর বউয়ের কলহ শুরু হলে, বিষয়টি ‘মায়ের আশকারা’ আখ্যা দিয়ে (বউ) ক্ষমা রানি গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দেয় শিবুবালার ঘাড় ও পিঠ। ওইরাতে বিষয়টি এলাকাবাসী মেনে নিতে না পেরে ক্ষমাকে আটকে রেখে শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ ক্ষমাকে আটক করেন। এ ঘটনায় স্থানীয়দের চাপেরমুখে পড়ে ছেলে গৌতম নন্দি বাদী হয়ে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলায় ক্ষমা এখন কারাগারে।
বৃদ্ধার ধারণা, বউমা জামিনে বাড়ি ফিরে ঘটাবেন লঙ্কাকাণ্ড। এর আগেই আমার জীবন বাঁচাতে হলে যেতেই হবে বৃদ্ধাশ্রমে। তেমন কোনো সহযোগিতাও মিলছে না, একা একা ভীষণ কষ্টে দিনযাপন করছেন শিবুবালা।
যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের সদর উপজেলার সাতমাইল বাজার থেকে মানিকদিহি গ্রামে ঢুকতেই রাস্তার ধারে একটি ঝিকঝাক দোতলা বাড়ি। গ্রামের মৃত কার্তিক নন্দির ছেলে গৌতম নন্দির তৈরি করা বাড়িটির নামফলকে লেখা রয়েছে ‘নন্দিভবন’। এই বাড়িতে গৌতমের বৃদ্ধা মা শিবুবালা, স্ত্রী ক্ষমা, গৌতমের এক ছেলের বসবাস করে।
সুদর্শন বাড়িটির প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে চোখে পড়লো কলাবসিবল গেট লাগানো বাড়িটির ফ্লোর টাইলস, বিদ্যুৎ-পানীয় জলসহ নান্দনিক সাজ। আর বাড়ির মূলগেটের বাইরে প্রাচীরের মধ্যেই হিন্দু পরিবারের নিদর্শন তুলশি গাছের পিড়ি, গোয়ালভর্তি গরু, আর গরুর গোয়ালের এক কোণায় ছোট্ট একটি চৌকি খাটের উপর এলোমেলোভাবে একটা মশারি টাঙানো রয়েছে।
স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, গোয়ালের কোণায় রক্ষিত ওই চৌকি খাটে থাকেন বাড়ি মালিক গৌতম নন্দির বৃদ্ধা মা শিবুবালা।
শনিবার (০৩ মার্চ) সন্ধ্যায় ওই গোয়াল ঘরে বৃদ্ধা মাকে দেখতে না পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করলে বাড়ি মালিকের বিবাহিত মেয়ে অনামিকা এসে জানালেন। তার ঠাকুমা গোয়ালে নেই, গতকাল ঘরে তোলা হয়েছে। পরে স্থানীয় সমাজকর্মী রুবেল হোসেনের সহযোগিতায় ঘরে ঢুকে বৃদ্ধা মায়ের দেখা মিলল।
গত শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বউয়ের হাতে গরম লোহার ছ্যাঁকা খেয়ে মহাবিপদগ্রস্ত সময়ে রুবেলসহ এলাকাবাসী তাকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলেন। এজন্যই সপ্তাহখানেক পর রুবেল হোসেনকে কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে চোখের জল ফেলতে শুরু করেন শিবুবালা।
সমাজকর্মী রুবেলসহ প্রতিবেশীরা বাংলানিউজকে বলেন, বৃদ্ধার পুত্রবধু তাকে থাকার জন্য গরুর গোয়ালের কোণায় জায়গা করে দিয়েছেন। তাকে ঘরে উঠতে দেন না। এমনকি, বৃদ্ধাকে তিনবেলা পেটভরে ভাতও দেওয়া হয়না। ছেলেদের মানসন্মানের ভয়ে বিষয়টি কোনোভাবেই লোকজানাজানি করতে চাননি শিবুবালা। কিন্তু গত শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে ছেলে-বউয়ের ঝগড়া করার একপর্যায়ে ছেলের বউ এসবের জন্য শাশুড়িকে দায়ী করেন। পরে ক্ষিপ্ত হয়ে গোয়ালঘরে গিয়ে লাঠি দিয়ে শাশুড়িকে মারধর এবং গরম লোহার ছ্যাঁকা দেন। পরে বৃদ্ধার গোঙানিতে আশপাশের লোকজন ছুঁটে এসে রক্ষা করেন। তার আগেই গরম লোহার ছ্যাঁকায় ঘাড় ও পিঠে জখম হয় শিবুবালার।
অমানবিক এ ঘটনায় পরদিন সকালেই গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে বৃদ্ধাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। বউয়ের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এলাকাবাসীর চাপ এড়াতে ছেলে গৌতম তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে লোকদেখানো মামলা করলে পুলিশ তাকে আটক করা হয়। যদিও আটকের পরদিন থেকেই গৌতমের স্ত্রীকে জামিনের জন্য চেষ্টা করছেন।
এদিকে বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় সাংবাদিক, প্রশাসন, সমাজকর্মীদের চোখ এড়াতে বৃদ্ধা মাকে হাসপাতাল থেকে জোর করে বাড়িতে নিয়ে ঘরে ঠাঁই দেন গৌতম।
বৃদ্ধা শিবুবালা বাংলানিউজকে বলেন, আমি আর কয়দিনই বাঁচবো, ভেবেছিলাম স্বামীর ভিটায় যেন মরতে পারি। তাইতো এতোদিন গোয়ালঘর আঁকড়ে পড়ে রয়েছি, এখন আমি কোথায় যাবো? আমিও তো চায়নি বউমা জেলে থাকুক। ছেলে-নাতিরা রাস্তায় ঘুরুক! বউম ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে সবকিছুতে আমাকে দায়ী করবে। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে! আমি এখন কি করবো, কই যাবো বলে মুর্ছা যান শিবুবালা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০১৮
ইউজি/এএটি