ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

খরস্রোতা তিস্তা এখন ধুধু বালুচর 

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৯
খরস্রোতা তিস্তা এখন ধুধু বালুচর  তিস্তায় পানি না থাকায় বালচুর পার হচ্ছে এক ব্যক্তি। ছবি: খোরশেদ আলম সাগর

লালমনিরহাট: বর্ষাকালের খরস্রোতা তিস্তাকে শীতকালে যেন  চেনাই যায় না। পানির কারণে ফুলে ফেঁপে ওঠা তিস্তা এখন পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের এক তরফা পানি নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা এখন মৃত প্রায়। ফলে তিস্তা অববাহিকায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।

তিস্তার বুকে ছুটে চলা জেলে আর মাঝি মাল্লাদের নেই আর আগের মত কর্মব্যস্ততা। পানির অভাবে থেমে গেছে তাদের সংসারের চালিকা শক্তিও।

থমকে গেছে লালমনিরহাটের তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবারের উপার্জন। উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে পড়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন জেলে ও মাঝি মাল্লারা।

জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।  

কর্ম ব্যস্ততা না থাকায় বসে আছে এক মাঝি।  ছবি: খোরশেদ আলম সাগরস্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবেশী দেশ ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানি প্রবাহ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আমাদের দেশে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপরই বাংলাদেশকে পানি দেয় ভারত। বর্ষাকালে ভারত অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা হয়। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী পানি মেলে না। এভাবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি এখনও।  

ফলে শীতকালে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়। লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

তিস্তা নদীতে দিনভর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলেরা আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে হেঁটেই তিস্তা পারি দেওয়া যায়, তাই খেয়া ঘাটের মাঝিদের আর নৌকা বাইতে হয় না। এ কারণে বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারা।  

বালুচরে বেঁধে রাখা নৌকাকেউ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও কেউ আবার তিস্তা ব্যারাজের সামনে সামান্য যে একটু পানি আছে তাতেই  পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণের আনন্দ দিয়ে আয় করছেন ডাল ভাতের টাকা। সব মিলে চিরচেনা হিংস্রো তিস্তা আজ পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত হয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। পানির অভাবে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে গাছপালা। আর তাই এই তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও চলে গেছে অন্যত্র।

তিস্তায় নানান প্রজাতির মাছের মধ্যে জনপ্রিয় বৈরালী/বুরাল মাছ। যা দেশের অন্যান্য এলাকায় অপ্রতুল। রাষ্ট্রীয় অতিথিরা এলে আপ্যায়নের মেনুতে থাকত তিস্তা নদীর সুস্বাদু এ মাছ। যা তিস্তার পানির অভাবে আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।  

তিস্তা নদীর উপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচড়া শেখ হাসিনা সেতু যেন প্রহসনমূলকভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধুধু বালুচরের তিস্তার উপর। ব্রিজ থাকলেও হেঁটেই পাড় হচ্ছে অনেকেই।  

তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরের বালুতে ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে তা মরে যাচ্ছে। অধিক পরিশ্রম করে প্রতিদিন সেচ দিয়ে কৃষক চাষাবাদ করছেন। তবে আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।

তিস্তা পাড়ের জেলে সাইদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার চলে তিস্তায় মাছ ধরে। ভরা তিস্তায় দিনভর মাছ ধরে ৪/৫শ’ টাকা আয় হলেও এখন মাছ কম তাই আয়ও কম। পানি না থাকায় তিস্তায় মাছও নেই। বর্ষাকালে বৈরালী, আইর ও বোয়াল মাছ পাওয়া গেলেও এখন আর তা পাওয়া যায় না। তিস্তা ব্যারাজের সামনে সামান্য পানিতে দিনভর মাছ ধরে আয় হয় মাত্র দেড় থেকে দুইশত টাকা। যা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।

তিস্তায় পানি নেই শুরু বাল চরনৌকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বর্ষাকালে খেয়া পাড়ে ও জেলেদের নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক  ৫/৬ শত টাকা আয় হত। কিন্তু এখন পানি শুন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। তাই তিস্তা ব্যারাজে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নৌভ্রমণের আনন্দ দিয়ে দিনভর ২/৩শ’ টাকা আয় করে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

তিস্তা ব্যারাজ এলাকার রাশেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বর্ষা মৌসুমে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এখন মাছ নেই তাই তিস্তা থেকে পাথর আরোহণ করছেন তিনি। পাথর কুড়িয়ে স্তুপ করে বিক্রি করেন প্রতি সিপ্টি পাথর মাত্র ৪৫/৫০ টাকায়। এই সামান্য আয়ে চলছে তার সংসার।

তিস্তা পাড়ের কৃষক তাহাজুল ইসলাম, আবুল মিয়া ও খালেক বাংলানিউজকে বলেন, বর্ষাকালে প্রচুর পানি ছেড়ে দেয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানীসহ ঘরবাড়ি হারা হয় এ অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষায় পানির প্রয়োজন হলেও তিস্তায় পানি দেয় না ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তা পাড়ের। নদী শাসন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না থাকায় তিস্তা নদী এলাকার কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।

আদিতমারী উপজেলার গোবর্দ্ধন তিস্তা পাড়ের সমাজকর্মী ফারহানা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দরকার। সেই সঙ্গে তিস্তা নদী শাসন করে জনগণের কল্যাণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। নচেৎ তিস্তা পাড়ের মানুষ দেশের উন্নয়নের বোঝা হয়েই থাকবে। পানি প্রবাহ সচল ও নদী শাসন হলে তিস্তার দু'তীরে ফসলের বিপ্লব ঘটবে। ঠিক তেমনিভাবে উদ্যোগ নিলে তিস্তার পানি প্রবাহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে জানান, আপাতত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা সিলড্রাপ ও ক্যানেলগুলো ভরে রাখা হয়েছে। এর চেয়েও যদি পানি কমে যায় তবে সেচ প্রকল্প সচল রাখাই কষ্টকর হয়ে যাবে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।