বুধবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে মিরপুরের রূপনগর এলাকার ১১ নম্বর সড়কে এক বেলুন বিক্রেতার ভ্যান ঘিরে ছিল শিশুদের ভিড়। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বিক্রেতা সিলিন্ডার থেকে একে একে বেলুনে গ্যাস ভরে শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছিলেন।
পুলিশে দেওয়া সর্বশেষ খবর অনুসারে, বেলুনে গ্যাস ভরার ওই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ শিশু। এরা হলো- রমজান (৮), নুপুর (৭), শাহীন (৯), ফাজানা (৬) ও রুবেল (১১)। এছাড়া এতে আহত হয়ে শিশুসহ আরও অন্তত ১৫ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
সন্ধ্যার দিকে নিহত শিশুদের মরদেহগুলো এনে রাখা হচ্ছিল সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগের সামনের চত্বরে স্বজনদের আহাজারিতে ক্রমেই ভারি হয়ে উঠছিল হাসপাতালের পরিবেশ। অকস্মাৎ এক বিস্ফোরণে কোথায় হারিয়ে গেছে খেলায় মেতে থাকা চঞ্চল শিশুর দল। মুহূর্তেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে সে সব শিশুর পরিবারগুলোর।
নিহত দুই শিশুর স্বজন আব্দুর রহমান জানান, তার বোন ফারজানা ও শ্যালক রুবেল ওই সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরেক বোন মরিয়ম ও শ্যালিকা সুমাইয়া। পরিবারের এ দুর্দিনে তিনি একেবারে দিশেহারা। এ অবস্থায় নিহতদের মরদেহ বুঝে নেবেন, নাকি আহতদের চিকিৎসার দেখভাল করবেন, কিছুই জানেন না। দেখা যায় ছলছল চোখে তিনি এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছেন আর পরিবারের অন্যদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
বুকে পাথর বেঁধে আছে আহত আরেক শিশু মরিয়মের শিশু ভাই রাসেল। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মরিয়মকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বোনকে কোলে করে জরুরি বিভাগ থেকে বের বেরিয়ে গেলো সে। তারও সারা শরীর রক্তে ভেজা।
রাসেল জানায়, বিকেলে তারা বেলুন কিনছিল। এরই এক পর্যায়ে হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে তার এক বোন ফারজানা নিহত ও আরেকবোন মরিয়ম আহত হয়। দুর্ঘটনার সময় ভাগ্যক্রমে সে ঘটনাস্থলে ছিল না। পরে খবর পেয়ে আহত বোনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়।
আহত আরেক শিশু মিরাজুল ইসলাম (৮) বাম হাতে আঘাত পেয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ডাক্তার তাকে ছেড়ে দিয়েছে।
মিরাজুল জানায়, দুর্ঘটনার সময় অনেক শিশুই ভ্যান থেকে বেলুন কিনছিল। মিরাজুলও গিয়েছিল। কিন্তু সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এরই মাঝে বিক্রেতা একটি বেলুনের গ্যাস ভরা শেষে আরেকটি বেলুনে গ্যাস ভরতে গেলে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে আঘাত পেয়ে সে খানিকটা দূরে গিয়ে পড়ে। পরের ঘটনা সে আর কিছুই বলতে পারে না।
এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ কয়েক শিশুর খোঁজে হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছে আরও কিছু মানুষ। তারা ছবি দেখিয়ে আহাজারি করতে করতে নিখোঁজ শিশুদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। মৃতদের মধ্যে তাদের শিশুটি নেই নিশ্চিত হলে আহতদের মধ্যে খুঁজে দেখতে ঢাকা মেডিক্যালে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে।
এরই মাঝে হেলাল নামে এক ভ্যানচালক এসেছেন তার নাতি মিজানের (৭) খোঁজে। তিনি জানান, দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়। তিনি অনেকটা দূর থেকেও সে শব্দ শুনেছেন। এরপরপরই দৌড়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বেশকয়েক শিশুকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। দুর্ঘটনার পর থেকেই তার নাতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই ছবি দেখিয়ে হাসপাতালে নাতির খোঁজ করছেন।
আরেক নারী তার ৫ বছর বয়সী মেয়ে মিনার ছবি দেখিয়ে কেঁদে যাচ্ছিলেন। আর্তনাদ করে একটানা বলছিলেন, ‘আমার মিনা কই? সে কি আছে?’
হতাহতদের প্রসঙ্গে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া সাংবাদিকদের বলেন, রূপনগরে বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের এখানে পাঁচ শিশুর মরদেহ এসেছে। এছাড়া আহত অবস্থায় আরও পাঁচজন এসেছিল। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে দুর্ঘটনার সংবাদে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বলেন, এ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করবো। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের নির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে, সেটি যাতে কঠোরভাবে মেনে চলা হয় সে ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন>>> ‘ভাইগো আমার হাতটা খুঁজে দেন, ডাক্তার জোড়া লাগিয়ে দেবেন’
বাংলাদেশ সময়: ২১৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
পিএম/এইচজে