ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি...

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯
উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি...

ঢাকা: ‘বেইজ ফর অল স্টেশনস, ভেরি ইমপোর্টেন্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। বেইজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। কিপ লিসেন, ওয়াচ। উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াবহ কাল রাত্রিতে রাজারবাগে অবস্থিত তৎকালীন পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়ারলেস বেজ স্টেশন থেকে এই বার্তাটি দেশের বিভিন্ন পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়েছিল। বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘হেলিকপ্টার ব্যাজ’ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এই বার্তাটি পাঠান।

ঢাকা আক্রান্ত হওয়ার এই বার্তা সারাদেশের থানাগুলোতে পাঠানোর পর প্রতিরোধ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাতের রাজারবাগ পুলিশের লাইন আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্ণনা করেছেন তৎকালীন বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

আপনি ইস্ট পাকিস্তান পুলিশে চাকরি করতেন। সেখান থেকে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের জন্য  অনুপ্রাণিত হলেন?

শাহজাহান মিয়া: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যখন দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে যায় এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত বাঙালি পুলিশরাও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন।

৭ মার্চের পর পুলিশে আমরা যারা বাঙালি ছিলাম, নিজেদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গোপনে আলাপ-আলোচনা করতাম। কারণ পুলিশ লাইনে অনেক অবাঙালি পুলিশও ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন তার ভাষণে বলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম..., তখন থেকেই আমরা গোপনে প্রস্তুতি নিতে থাকি যুদ্ধের।

২৫ মার্চের রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কথা জানতে চাই।

শাহজাহান মিয়া: আমি তখন ওয়ারলেস অপারেটরের দায়িত্বে ছিলাম। সেই সময়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন ওয়ারলেস অপারেটর এবং কয়েকজন মেকানিক স্টাফ ছিলেন। মৌচাক মার্কেটের পাশে ২০৬ নিউ সার্কুলার রোডে আমাদের থাকার হোস্টেল ছিল। তখন ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা। উনার ছোট ছেলের সাথে আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। রাতে খাওয়ার পর গোলাম মোস্তফার ছেলে হোস্টেলে এসে আমাকে বলে, আজকে রাতেই পাকসেনারা আক্রমণ করবে। রাজারবাগ হেডকোয়ার্টার এবং ইপিআর আক্রমণ হতে পারে। বঙ্গবন্ধু এই সংবাদটা আমাদেরকে জানাতে বলেছেন। এই সংবাদ শুনে আমরা তাৎক্ষণিক পোশাক পরে হোস্টেল থেকে রাজারবাগের দিকে রওনা হয়ে যাই।

‘আমরা যখন রাজারবাগ পৌঁছাই তখন নাইট রোলকল হচ্ছিল। রাজারবাগ আক্রমণের খবর যখন বলি, তখন সবাই উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেই তারা যদি আক্রমণ করে তাহলে আমরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে আমাদের অস্ত্রের প্রয়োজন। তখন রাজারবাগের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আরআই) মফিজ উদ্দিনের কাছে অস্ত্রাগারের চাবি থাকতো। উনার কাছে আমরা সবাই যাই, ততক্ষণে উনিও রাজারবাগ ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমরা তার কাছ থেকে অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে গোলাবারুদ নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেই। তখন অস্ত্র বলতে আমাদের কাছে শুধু থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল।

আমরা তখন কেউ ছাদে, কেউ ব্যারাকে, কেউ পুকুরপাড়ে পজিশন গ্রহণ করি। তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আসার দুটি পথ ছিল একটি বাংলামোটর মগবাজার মালিবাগ হয়ে (তৎকালীন সময়ে নাম পাকমোটর) আরেকটি পথ হলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল দিয়ে। এই দুইটা পথেই আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পজিশন গ্রহণ করে। আমাদের ১০-১২ জনের একটা গ্রুপ চামেলীবাগে বর্তমানে ইস্টার্নপ্লাস (তখন এখানে ছিল ডন হাই স্কুল) ছাদে পজিশন নেয়। স্কুলের সামনেই পুলিশ ও স্থানীয় জনগণ ব্যারিকেড তৈরি করে যেন গাড়ি আসলে এখানে গতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

তখন আমি মনির নামে আমার একজন সহকর্মীকে নিয়ে ওয়ারলেস বেজ স্টেশনে আসি। এরপর আমি ওয়ারলেস বেজ স্টেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করি। তখন রাত আনুমানিক ১০টা ১০ হবে। আমি তেজগাঁও এলাকা থেকে একটি ম্যাসেজ পাই। তেজগাঁও আমাদের যে পেট্রোল বাহিনী ছিল তাদের সেই মেসেজের কল সাইন ছিল, চার্লি সেভেন। চার্লি সেভেন থেকে আমাকে কল করা হলো। ‘চার্লি সেভেন ফর বেজড হাউ ডু ইউ হেয়ার মি? ওভার। ’ উত্তরে আমি বলি, ‘বেজড ফর চার্লি সেভেন ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। সেন্ড ইয়োর মেসেজ। ’ তখন চার্লি সেভেন বলছে, 'চার্লি সেভেন ফর বেজড অ্যাবাউট ৩৫ থেকে ৩৭ ট্রাক লোডেড উইথ পাক আর্মি প্রসিডিংস টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফরম দা ক্যান্টনমেন্ট ওভার। ’ আমি বললাম, বেজড ফর চার্লি সেভেন রোজার আউট অফ ইউ।

এই মেসেজ আমি প্রথমে ট্রান্সমিট করি অল ওভার ইস্ট পাকিস্তান। পাকিস্তানি আর্মি আসার খবরটি আমি সকলকে জানিয়ে দেই। এই খবরটা পাওয়ার পর আর কারও জানতে বাকি রইল না পাকিস্তানি আর্মিরা বেরিয়ে পড়েছে। তখন একজন পুলিশ লাইনের পাগলা ঘণ্টা বাজানো শুরু করে। পাগলা ঘণ্টা বাজানোর পর সবাই আরো বেশি অ্যালার্ট হয়ে পড়ে। প্রথমবার যারা আসেনি দ্বিতীয়বার তারাও এসে পড়ে এবং অস্ত্র চাই বলে চিৎকার করতে চাই। তখন তারা শাবল দিয়ে আরেকটি অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র বের করে নিয়ে এসে যেখানে সালাম নেওয়া হয় সেখানে জড়ো হয় এবং স্লোগান দিতে থাকে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ স্লোগানে রাজারবাঘ মুখরিত করে তোলে। এরপর তারা যে যার পজিশন মতো চলে যায়।

রাত আনুমানিক সাড়ে এগারোটায় পাক-হানাদার বাহিনীর একটা বড় ধরনের কনভয়  ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের রাস্তা দিয়ে রমনা পার্ক হয়ে বেলিরোড দিয়ে শান্তিনগর ক্রস করে চামেলীবাগে ঢুকে পড়ে। তখন ব্যারিকেডের সামনে এসে তারা থামে। ব্যারিকেড সরানোর চেষ্টা করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ডন স্কুলের ছাদে যারা পজিশন গ্রহণ করেছিল তারা ফায়ার ওপেন করে। এতে দুজন খানসেনা মারা যায় এবং অনেকে আহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রথম বুলেট নিক্ষেপ করে আমাদের পুলিশ। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যারিকেড অপসারণ করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেশিনগান, মর্টার শেল, কামান সকল অস্ত্র দিয়ে একসাথে রাজারবাগের চারপাশ থেকে আক্রমণ করে। তারা বিদ্যুৎ এবং টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

একটি হারিকেন জ্বালিয়ে আমি কী করবো ভাবছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওই কথাটি, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবা...। তখন বারবার তা মনে পড়ছিল। তখন আমি ভাবলাম আমার কাছে যে ওয়ারলেস সেট রয়েছে এটি ব্যবহার করে আমিতো সমগ্র বাংলাদেশকে জানিয়ে দিতে পারি, আমরা আক্রান্ত হয়েছি এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলছি। তারাও যেন প্রতিরোধের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে এই কথাটি আমার বিবেককে নাড়া দেয়। তখন সহকর্মী মনিরকে বললাম এটা করলে কেমন হয়। মনির বলে শাহজান ভাই এটা করলে অনেক ভালো হয়। তারপর আমি নিজেই একটা মেসেজ অরিজিনেট করলাম। এরপর আমি বলতে শুরু করলাম, বেইজ ফর অল স্টেশনস, ভেরি ইমপোর্টেন্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। বেইজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। কিপ লিসেন, ওয়াচ। উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট। ’

তখনকার দিনে ১৯টি জেলা ছিল এবং ৩২টি মহকুমা ছিল। আমি একযোগে এক চ্যানেলে ট্রান্সমিট করতে সক্ষম হই। এরপর আমি আর বেইজ স্টেশনে অবস্থান করতে পারিনি। আমি এবং মনির চলে গেলাম ছাদে। রাত দুইটা পর্যন্ত আমরা পাকসেনাদের প্রতিরোধ করে রেখেছিলাম। এরপর পাকসেনারা দুইটা ট্যাংক দিয়ে গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ার করে আমাদের এক থেকে দেড়শ পুলিশকে হত্যা করে। আমাদেরকে লক্ষ্য করে তারা হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলি বর্ষণ করে। আমরাও থ্রি নট থ্রি দিয়ে তাদেরকে আক্রমণ করতে থাকি। আমাদের গুলি শেষ হয়ে গেলে আর প্রতিরোধ করে রাখতে পারিনি। তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে তারা সমগ্র রাজারবাগ দখল করে নেয়।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
আরকেআর/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।