বাংলানিউজ: বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের শৈশবের কিছু কথা জানতে চাই।
এম শফিকুর রহমান: মতিউর রহমান আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করার পর বাবা মতিকে সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি করান। ও মেধাবী ছাত্র হওয়ায় অধিকাংশ পরীক্ষাতেই প্রথম হতো। মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে ও। ১৯৬১ সালে বিমান বাহিনীতে যোগ দেয়। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পি.এ.এফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হয়।
এরপর করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্শন কোর্স শেষ করে পেশোয়ারে গিয়ে জিডি পাইলট হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিল মতিউর। এরপর মিগ কনভার্শন কোর্সের জন্য আবারও সারগোদায় যায় ও। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই একটা মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশেই সেটা বিকল হয়ে যায়, কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে প্যারাসুট নিয়ে মাটিতে অবতরণ করে মতিউর। ১৯৬৭ সালেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করে ও। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় মতিউরই ছিল একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দুই বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০ সালে বদলি হয়ে আসে জেড ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে। ভালো ছাত্র, খেলোয়াড় সর্বোপরি ভালো মানুষ হিসেবে মতিউরের খুব সুনাম ছিল। ও টেনিস ভালো খেলত। ফুটবল, ক্রিকেটও ভালো খেলত। ওদের ওখানে এগুলো প্র্যাকটিস করানো হতো। হর্স রাইডিংও পারতো সে।
বাংলানিউজ: কেমন স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি?
এম শফিকুর রহমান: অনেক উচ্ছল, প্রাণচঞ্চল মানুষ ছিল ও।
বাংলানিউজ: ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মতিউর রহমান ঢাকায় ছুটিতে আসেন। তখনকার কোনো স্মৃতি মনে আছে?
এম শফিকুর রহমান: হ্যাঁ, আগেও কয়েকবার এসেছিল। আসার আগে বলতো- তোমরা সব রেডি করো আমি আসছি। আসার সময় বড় এক ঝুড়ি আঙ্গুর নিয়ে আসতো। সে মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করত। ভোজনবিলাসী ছিল। একদম মাটির মানুষ। তার মধ্যে কোনো বাহাদুরি বা অহংকার ছিল না। আমাদের বাসার পাশে আমরা পিকনিক করতাম। মতি লিড দিতো। এসব করে ও খুব মজা পেত।
বাংলানিউজ: তিনি কোন ধরনের গান শুনতেন?
শফিকুর রহমান: রবীন্দ্রনাথের গান খুব পছন্দ ছিল ওর। শ্যামা সংগীত, রবীন্দ্রনাথের গানের রেকর্ড ছিল ওর সংগ্রহে। মতির মুখে মুখে গানগুলো থাকতো। আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে একসাথে গান গাইতো সে।
বাংলানিউজ: কেমন সাহসী ছিলেন তিনি?
শফিকুর রহমান: ২৫শে মার্চের কালরাতে মতিউর রহমান ছিল বাংলাদেশের রায়পুরার রামনগর গ্রামে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুলেছিল। যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতো। মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে ও এক প্রতিরোধ বাহিনীও গড়ে তুলেছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে ওদের ঘাঁটির ওপর বোমাবর্ষণ করে। মতিউর আগেই এটা আশঙ্কা করেছিল। ফলে আগে থাকতেই ঘাঁটি পরিবর্তন করা হয়, আর তাতে ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় মতি আর ওর বাহিনী। পরে ও দৌলতকান্দিতে জনসভা করে। বিরাট এক মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যায়। পাকসেনারা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর’র সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরি করে মতি। পরে ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসে। ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে জঙ্গি বিমান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরের কথা তো সবাই জানে।
বাংলানিউজ: মতিউর রহমানের পরিকল্পনা কীরকম ছিল?
শফিকুর রহমান: মতিউরের ইচ্ছে ছিল এ দেশে থেকে যুদ্ধ করার। একবার রায়পুরার গ্রামের বাড়িতে চাষের জমির মাটি মুঠোবন্দী করে বলল- ওরা (পাক সেনারা) আমার দেশ, আমার মায়ের ছেলেদের গুলি করে এই সোনার মাটি রঞ্জিত করেছে। আমি এর বদলা নেবো। আমরা ওকে এক প্রকার জোর করতাম পাকিস্তানে ফিরে যেতে। দেশে থাকলে মতি আর ওর পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন থাকতো। করাচি ফেরার আগে মতি প্লেন ছিনতাইয়ের চিন্তাও করেছিল। পরে যা করলো তা আজ ইতিহাস।
বাংলানিউজ: আপনিতো মতিউর রহমানের পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকের ট্রেনিংয়ের সময় গিয়েছিলেন। সে সময়ের কোনো স্মৃতি কী আপনার মনে আছে?
শফিকুর রহমান: ওর একটা টয়োটা গাড়ি ছিল। ও এতই দুঃসাহসী ছিল যে, প্লেন যেমন দ্রুত গতিতে চালাতো, গাড়িও তেমনি দ্রুত গতিতে চালাতো। স্টিয়ারিং কন্ট্রোল না করতে পেরে একবার গাড়ি উল্টে দুমড়েমুচড়ে যায়। সেবারে লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ও। পরে বলেছিল, গাড়ি নষ্ট হলেও ওর তেমন কিছুই হয় নাই। সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। তবে সাহসী আচরণে ওর সিনিয়ররা মাঝে মাঝে রাগ করতো। বলতো, এমন করলে ভবিষ্যতে কী হবে?
বাংলানিউজ: মতিউর রহমানের সঙ্গে আপনার শৈশবের কোনো ঘটনা মনে আছে?
শফিকুর রহমান: ও তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। আমিও দূরন্ত ছিলাম। ছুটিতে বাড়িতে আসার পর মজা করেই গরম খুন্তি দিয়ে মতির পিঠে ছেঁকা দেই। এরপর ও আমাকে ডাঁটাশাক হাতে প্রায় আধা মাইল তাড়া করে।
বাংলানিউজ: মতিউর রহমানের স্ত্রী, সন্তানের সঙ্গে আপনাদের নিয়মিত যোগাযোগ হয় কী?
শফিকুর রহমান: ওরা আমেরিকাতে স্থায়ী। কম কথা হয়। মেয়ে দুটো ওখানে ভালো আছে। মিসেস মতিউর রহমান মাঝেমাঝে দেশে আসেন। আমারও বয়স হয়েছে। মতির কথা, ওর স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে পড়ে। ওরা যেখানেই থাকে ভালো থাকুক, এটাই চাই।
বাংলানিউজ: বীরশ্রেষ্ঠদের স্মরণে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
শফিকুর রহমান: ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন বেঁচে থাকবে মতিরা (বীরশ্রেষ্ঠরা)। ততোদিন মানুষ তাদের মনে রাখবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৯
এমএমআই/এইচজে