পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশে উদিত হয়েছিল নতুন সূর্য। নাগপাশ মুক্ত হয়েছিল পাক বাহিনীর।
মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদররা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও রাজশাহীতে স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা ওড়ে দুইদিন পর। দীর্ঘ নয় মাস বিভীষিকাময় সময়ের অবসান ঘটে।
বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর আত্মপরিচয়ের ঠিকানা করে নেওয়ার অনুভূতিতে পুলোকিত হয়ে ওঠে রাজশাহীর মানুষ। মুক্তিকামী জনতার ঢল নামে প্রতিটি সড়কে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী অঞ্চলকে নেওয়া হয় ৭নম্বর সেক্টরে। বিদেশি প্রতিনিধিদের পরিস্থিতি জানাতে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্ত পার হয়ে আসে। একাত্তরের ১৭ জুন ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুরু করে তাদের অ্যাকশন অপারেশন। পাকিস্তানি সৈন্য ও দোসরদের নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকে। রাজশাহীর নারীরাও অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভূমিকা রাখেন, কেউ এ পারেই হয়ে ওঠেন দুঃসাহসিক গেরিলা।
ওই সময় আলবদর বাহিনী গঠনের পর শুরু হলো ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ নানা নিপীড়ন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে হত্যা করলো চার হাজার মানুষকে। নারীরাও তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহকারী ও গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু বলেন, পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসরদের মদদে বিভিন্ন কায়দায় মানুষকে হত্যা করে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। এসময় রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা মহানগরীর শ্রীরামপুর বাবলাবন চরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন্ত অবস্থায় বালির মধ্যে পুঁতে হত্যা করে। সবকিছু সহ্য করে স্বাধীনতার দিন গুণতে থাকে রাজশাহীর মানুষ।
মিত্র বাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানাতে সবাই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সে সময় পাক-সেনাদের বিমান বোমা ফেলতে থাকলো রাজশাহীতে। লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও সেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের সঙ্গে লড়াই করে মুক্ত করে ফেলে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চল।
মহদিপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রাজশাহী অ্যাডভান্সের পরিকল্পনা নিলেন। তিনি ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহায় চরে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী রাজশাহীর দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় বরণের পর যৌথ বাহিনীর এ অগ্রগামী দল পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে সাদা পাগড়ী ও আত্ম-সমর্পণের চিঠি নিয়ে রাজশাহী শহরে বীর দর্পে প্রবেশ করে।
তাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, মহানগরীর সোনাদিঘীর মোড়ে সাংবাদিক মঞ্জুরুল হকের বাড়িতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল, জেলখানা ও বিভিন্ন বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে নির্যাতিত মানুষেরা। স্বজন হারানোর কষ্ট আর স্বাধীনতার উল্লাসে গোলাপ পানি ফুলের পাপড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা-মিত্র বাহিনীকে বরণ করে নেয় রাজশাহীর মানুষ।
১৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় রাজশাহী। রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলেন লাল গোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যায় নাটোরে।
তাদের দোসররা এখানে-সেখানে লুকিয়ে যায়। খাদ্যসংকট এড়াতে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়। রাজশাহীর মানুষ আজকের দিন থেকে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯
এসএস/ওএইচ/