এ কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পক্ষ থেকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা দুর্ঘটনা বলা হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৃত কারণ জানা যায় না। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় বিদেশ গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অনেক শ্রমিক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে, যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বন্ধ থাকা অনেক শ্রমবাজার নতুন করে চালু করা যায়নি। এদিকে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনায় ভবিষ্যতে রেমিটেন্স বাড়ানো এবং শ্রমবাজারে বাংলাদেশের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এখনই সমস্যার কারণ উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য কর্মস্থলে নিরাপত্তা সুরক্ষার পাশাপাশি কাজের শর্ত সম্পর্কে কর্মীকে আগেই অবহিত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
এদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরির জন্য অভিবাসীর মর্যাদা ও পরিবারের সদস্যদের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিবছরের ন্যায় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালন করা হবে। এবারের অভিবাসী দিবসের স্লোগান হচ্ছে ‘সামাজিক মেলবন্ধনের জন্য অভিবাসন’। দিবস উদযাপনে র্যালির আয়োজন ছাড়াও ১৯ ডিসেম্বর দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। এদিন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠেয় কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৪টি দেশের ৪২ জন অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সম্মাননা দেওয়া হবে। বিদেশগামী কর্মীদের জন্য প্রবর্তিত জীবন বিমা কর্মসূচির উদ্বোধন, প্রবাসী কর্মীদের মেধাবী সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, অভিবাসন মেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ থাকবে নানা আয়োজন।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশ থেকে আসা মরদেহের সংখ্যা বাড়ছে। গড়ে প্রতিদিন ১১ জন শ্রমিকের মরদেহ দেশে আসছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১১ বছরে দেশে বিদেশ থেকে মরদেহ এসেছে ৩৪ হাজার ৩৮৫ জনের। এগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫, ২০১০ সালে ২ হাজার ৫৬০, ২০১১ সালে ২ হাজার ৫৮৫, ২০১২ সালে ২ হাজার ৮৭৮, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭৬, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৮৭ ও ২০১৮ সালে এসেছে ৩ হাজার ৭৯৩ জনের মরদেহ দেশে এসেছে। আর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে বিদেশ থেকে এসেছে প্রায় ৩ হাজার ৬৬৮ জনের মরদেহ। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। স্বাভাবিক মৃত্যু পাওয়া গেছে মাত্র ৫ শতাংশ প্রবাসীর। বাকিদের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে, দুর্ঘটনা, হত্যা বা আত্মহত্যার কারণে। এর বাইরে অনেক প্রবাসীর মরদেহ বিদেশেই দাফন করা হয়। বিশেষ করে সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এমনটা বেশি দেখা যায়।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে কোনো প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মধ্যপ্রাচ্যে তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। ফলে কিছু কর্মী হিটস্টোকে মারা যায়। এজন্য আমাদের হার্ট ফাউন্ডেশন বলেছে কর্মী প্রেরণের আগে তাদেরকে সে দেশ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা দিলে এ সংখ্যা কিছুটা কমে আসবে।
তিনি আরও বলেন, এর বাইরে দেখা গেছে আত্মহত্যা করছে আমাদের কর্মীরা। রোড এক্সিডেন্টেও মারা যাচ্ছে। তবে আত্মহত্যা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন রয়েছে। এ বছরে গত ১১ মাসে ১৯ জন ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে। তাদের তালিকা সেসব দেশের কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছে আত্মহত্যার সঠিক কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। তারা এটার তদন্ত করবে। এছাড়া আমাদের মৃত কর্মীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। এই রিপোর্ট কেউ না চাইলে দেয় না। নরমালি যেখানে মারা যায় সেখাই এ রিপোর্ট করতে হয়। আমরা চেষ্টা করছি এখন থেকে মৃত ব্যক্তির পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট নেওয়ার রেওয়াজ চালু করতে। যেন এই রিপোর্ট আমার দেশে চেক করতে পারে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ জুলহাস বলেন, শুধু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে স্ট্রোক করেই যে শ্রমিকেরা মারা যাচ্ছে বিষয়টি তা নয়। দুর্ঘটনা, অসাবধানতাও এর জন্য দায়ী। তবে প্রবাসে শ্রমিক পাঠানোর আগে সে দেশের পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত করেই পাঠানো হয়। বোর্ড প্রবাসীদের মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করে। আইন অনুযায়ী শ্রমিকের মরদেহ দেশে ফেরার পর দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা ও পরবর্তী সময়ে নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা একাধিক সংস্থা বলছে, প্রবাসে গিয়ে শ্রমিকরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের পাশাপাশি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় মেটাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় তাদের। এতে তারা প্রচুর মানসিক চাপে থাকে। ফলে বেশিরভাগ প্রবাসীর মৃত্যু হয় স্ট্রোকে, হৃদরোগ আর দুর্ঘটনায়। আর নারীদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয় নির্যাতন অথবা আত্মহত্যায়। কিন্তু প্রকৃত সত্য বের হচ্ছে না। এজন্য অস্বাভাবিক মৃত্যু প্রতিরোধে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করাটা জরুরি।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, গত ১৪ বছরে ৪০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে ৬১ শতাংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আর মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশের মধ্যে শুধুমাত্র সৌদি আরব থেকে এসেছে ৩১ শতাংশ শ্রমিকের মরদেহ। দিন দিন কেন এই মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে তা নিয়ে কোনো ধরনের গবেষণা নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে। যদি আগে থেকে বিদেশের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হতো, তবে অন্তত ১০ শতাংশ মৃত্যু কমানো সম্ভব হতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, স্বাভাবিক মৃত্যু হলে অন্য কথা কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে রাষ্ট্রের কিছু করণীয় নেই এটা আমি মনে করি না। দায়সারাভাবে পরিবারকে মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়াটা খুব অসম্মানজনক। মৃত্যুর কারণ অবশ্যই সরকারিভাবে যাচাই করা এবং তা প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া উচিত। এজন্য বিদেশ যাওয়ার আগে, যথাযথ প্রশিক্ষণ নেওয়া আর অভিবাসন নীতিমালা অনুসারে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও চাকরির শর্ত সম্পর্কে কর্মীদের অবহিত করতে হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত দশ বছরে সবচেয়ে বেশি মরদেহ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, জর্ডান, কাতার ও লেবাননে বেশিরভাগ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তবে এরমধ্যে সৌদি আরবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। গেল বছর হাজারেরও বেশি শ্রমিক দেশটিতে নানাভাবে মারা যায়। এছাড়া মালয়েশিয়া থেকেও আসছে শ্রমিকদের মরদেহ। সুখের আশায় প্রবাসে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন নারী কর্মীরা। সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা যারা দীর্ঘদিন ধরে অভিবাসন নিয়ে কাজ করছে, তাদের কাছেও নেই মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯
জিসিজি/এইচএডি