সম্প্রতি ব্র্যাক ব্যাংক ছেড়ে কান্ট্রি প্রধান ও সিইও হিসেবে যোগ দিয়েছেন কাজী আইটিতে। নারীদের কর্মক্ষেত্রের স্বাধীনতা ও তাদের সংগ্রাম নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হলো কাজী আইটির নিকুঞ্জ অফিসে।
বাংলানিউজ: সময় কেমন যাচ্ছে আপনার?
জারা: সত্যি বলতে জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় কাটছে এখন। একটা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছি। নিজের কাজের মূল্যায়ন পাচ্ছি, সব মিলে বেশ ভালো যাচ্ছে দিন। আসলে জীবনে বেশ সংগ্রাম করেই আজকের এই চেয়ারে বসতে পেরেছি। কারো জন্যই সফলতা সহজে ধরা দেয় না, নারীদের জন্য তো সেটা আরো কঠিন। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি জীবনে হাজারো কষ্ট করেন এবং বিনিময়ে কাঙ্খিত জায়গায় যেতে পারেন তাহলে সব সার্থক। আর তার জন্য কখনও হাল ছাড়া যাবে না।
বাংলানিউজ: তাহলে আপনি কাঙ্খিত জায়গায় আসতে পেরেছেন?
জারা: (মৃদু হাসি) দেখুন মানুষের জীবনটা খুব আপেক্ষিক। কোথায় যে তার পরিপূর্ণ শান্তি সেটা সে নিজেও জানে না হয়তো। তবে হ্যাঁ, সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া করি তিনি আমাকে মনের মতো একটা পরিবার দিয়েছেন, কর্মক্ষেত্রেও এখন খুব ভালো পজিশনে এনেছেন। আমি ১৯৯১-৯২ এর দিকে যখন উঠতি বয়সে ছিলাম তখন মডেলিং শুরু করি। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে আমাকে বহু সামাজিক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। হাল ছাড়িনি, একসময় ভালোবাসার মানুষ নাভিদ মাহবুবকে বিয়ে করে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই। সেখানে যাওয়ার আগে বেশ কিছুদিন বাবার অসুস্থতার সময়ে নিজেদের গামেন্টর্স দেখতে হয়েছে আমাকে। পরে যুক্তরাষ্ট্রের “ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার হাস্ স্কুল অব বিজনেস” থেকে এমবিএ শেষ করে বাংলাদেশে আসি। এখানে এসে যোগ দেই ব্র্যাক ব্যাংকে। এখন আমেরিকার এই প্রতিষ্ঠিত আইটি কোম্পানির সিইও হিসেবে জয়েন করলাম। এখানেও চ্যালেঞ্জ আছে, তবে আমি খুব কাছ থেকে এগুলো মোকাবেলা করতে চাই। নিজের দক্ষতা দেখাতে চাই।
বাংলানিউজ: ব্যাংক ছেড়ে আইটি খাতে কেন?
জারা: দেখুন ব্যাংকিং খাতটা এখন প্রতিষ্ঠিত। সেখানে প্রচুর মানুষ কাজ করছে এবং কাজের ক্ষেত্রটা অনেকটা ধরা বাঁধা। তবে আইটি খাতটা এখন আশির দশকের গামেন্টর্স খাতের মতো, মাত্র উঠতে শুরু করেছে। আমি মনে করি সৃষ্টিশীল বহু কিছু করার আছে এখানে। উন্নত বিশ্বের হাজার রকমের কাজ আছে যা ওরা অন্যদের দিয়ে করায়। সেই ক্ষেত্রে ভারত কিংবা ফিলিপিনের মতো দেশ বহু এগিয়ে গেছে। তবে সামনের সময়টাতে বাংলাদেশ এই খাতে নেতৃত্ব দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। একদিকে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ অন্যদিকে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আনার আগ্রহ এই দুইয়ে মিলে সময়টা বাংলাদেশের হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। সেই ক্ষেত্রে কাজী আইটিকেও আগামী কয়েক বছরে ১০ থেকে ২০ গুণ করতে পারবো ইনশাল্লাহ্। তবে তা করতে হলে সরকারকেও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।
বাংলানিউজ: সরকারের কী করার আছে বলে মনে করেন...
জারা: এখানে সরকারের বহু কিছু করার আছে। শক্তভাবে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে তাদের। দেখুন কাজী আইটিতে যেটা আমি দেখছি, আমাদের তিনটা অফিসে বহু ডেস্ক এখনো খালি পড়ে আছে। বার বার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও আমরা যোগ্য লোক খুঁজে পাচ্ছি না। কারণটা কী? আউটসোর্সিংয়ের কাজে অবশ্যই খুব ভালো ইংরেজি জানতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা এখনো অনেকটাই পিছিয়ে যার কারণে একজন মাস্টার্স পাস শিক্ষার্থীও ভালো করে ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারে না। শুধু তাই নয়, তারা কম্পিউটারের তেমন কিছুই জানে না। শুধু ফেসবুকিং আর ইউটিউবেই তাদের দক্ষতা গড়ে উঠছে। এতে করে যা হচ্ছে, সার্টিফিকেটের সংখ্যা ভারী হচ্ছে তবে বাড়ছে না মানসম্পন্ন কর্মী। যার কারণে একদিকে লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে চাকরি পাচ্ছে না, অন্যদিকে আমরা কর্মী খুঁজে পাচ্ছি না। এই বিষয়টি নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনে উন্নত বিশ্ব থেকে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ আনতে হবে। তাহলেই আগামী দিনে জনগোষ্ঠী থেকে জনসম্পদ তৈরি হবে।
বাংলানিউজ: আপনি তো একজন নারী আইকন, কর্মজীবী নারীদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
জারা: দেখুন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কথাটিই বলতে হয়, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। ” যদি অর্ধেক নারীরাই করে তাহলে তাদেরকে পুরুষের সমান সুযোগ দিতে হবে। একটা সময় ছিলো যখন নারীরা কোন চাকরি করবে সেটা সমাজ স্বাভাবিক ভাবে নিত না। আর এখন? এখনতো দেশ চালাচ্ছে নারীরা। পাইলট হচ্ছে তারা। কোনো জায়গা নেই যেখানে নারীরা পিছিয়ে আছে। আমিতো মনে করি নারীদের পিছিয়ে থাকার দিন আর নেই, জাদুঘরে থাকতে পারে। তবে হ্যাঁ, পুরুষ শাসিত সমাজে এখনো চিন্তা চেতনার অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। রাস্তা-ঘাটে, গাড়িতে, বাসট্যান্ডে এমনকি ক্যাম্পাসে এখনো নারীদের বিভিন্নভাবে হয়রানীর শিকার হতে হয়। এটা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। আপনাকে মাথায় রাখতে হবে, একজন পুরুষের চেয়ে নারী কোনো অংশেই কম নয়। তাই তাদেরকে সম্মান দিলেই কেবল একটা সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে না পারলে দেশের উন্নয়ন কি সম্ভব?
বাংলানিউজ: সম্প্রতি আপনার প্রতিষ্ঠান “ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ড” পেয়েছে, কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
জারা: কাজী আইটি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আনছে। আইটি কোম্পানিগুলো বেশিরভাগ দেশের বাজার টার্গেট করলেও আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমরা আমাদের তরুণ জনশক্তি ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্রচুর রেমিট্যান্স আনতে চাই। আর গেলো বছরের আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সেরা রেমিট্যান্স আয় করে আমরা ‘ডেইলি স্টার আইসিটি অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করতে পেরেছি। সেই অনুভূতি সত্যিই দারুণ। আপনি যখন কোনো পুরস্কার পাবেন, তখন কাজের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে যাবে। আমরা সেই শক্তিটাকে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি আয় করে যেতে চাই।
বাংলানিউজ: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জারা: বাংলানিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২০
এমআইএস/এজে