‘শামিমা নুর পাপিয়া’ যিনি ‘পাপিয়া পিউ’ নামেই অন্ধকার পাড়ায় বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই পাপিয়াই ‘বড় দেশপ্রেমী’ অতি সাধারণ হিসেবে ‘আবেগী ইমেজ’ গড়ে তুলেছিলেন।
তার পুরো ফেসবুক ওয়াল ঘেঁটে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে এই নারী কোনো এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার জগতের সম্রাজ্ঞী। ‘পোশাকী ইমেজের’ আড়ালেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতার এক ফাঁদ। যে ফাঁদে একবার কেউ পা দিলে ফেঁসে যেত চিরকালের জন্য।
জাতীয় দিবসগুলোতে দেশ নিয়ে বেশ ‘আবেগঘন’ স্ট্যাটাস দিতেন র্যাবের হাতে ধরা পড়া অপরাধ জগতের এই ছদ্মবেশী নারী।
দাপ্তরিক নাম শামীমা নুর পাপিয়া হলেও ‘পাপিয়া চৌধুরী’ নামে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করতেন তিনি। সেই আইডিতে তার বিভিন্ন সময়ের পোস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নরসিংদীতে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় উপস্থিতি ছিল তার। সেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ছবি তিনি শেয়ার করতেন।
গেল বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে পাপিয়া লেখেন, ‘নিজে যতই সাদা কালো হই না কেন, দেশটাকে রঙিন রাখার স্বপ্ন দেখি। সফলতা আমার হাতে নেই, কিন্তু সফলতার কাতারে দর্শক হতে বাধা নেই। আমিই বাংলাদেশ। ’ সঙ্গে একটি ছবিও যুক্ত করেন পাপিয়া। ছবিতে দেখা যায়, গাড়ির বনেটে জাতীয় পতাকা আর তার সামনে পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে প্রতাপশালী এই নারী।
এর আগের দিন অবশ্য সাবিনা ইয়াসমিনের সুরে সুর মিলিয়ে দেশের সূর্য সন্তানদের জন্য ‘সবকটা জানালা খুলে রাখতে’ বলেছিলেন পাপিয়া। নরসিংদী জেলা মহিলা যুবলীগের ব্যানারে ‘লাল সবুজের বিজয়ী শুভেচ্ছা’ জানিয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিও গভীর ভালোবাসা আছে পাপিয়ার। ‘ছাত্রলীগের ঐতিহ্যের অহংকারে মাথা অবনত হয়ে আসে’ বলেও স্টাটাস দেন পাপিয়া। সংগঠনটির ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গত ৫ জানুয়ারি ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘…বিপুল ভালোবাসার পরেও যে ভালোবাসা রয়ে যায়, তার নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এই একটা জায়গায় আমাদের আবেগ গাঢ় হয়ে আসে, ঐতিহ্যের অহংকারে আমাদের মাথা অবনত হয়ে আসে। ভালোবাসি ছাত্রলীগ। …’
তবে এমনই ‘দেশপ্রেম’ আর ‘স্বচ্ছ’ (!) রাজনীতি করা পাপিয়া এখন আছেন পুলিশি রিমান্ডে। অবশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে অর্থ্যাৎ সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করলে বোঝা যায়, সহজে দমে যাওয়ার পাত্রী নন পাপিয়া। র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন আগেই ১৫ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে পাপিয়া লেখেন, ‘চেষ্টা কখনো ছাড়া উচিত নয়, কারণ চাবিগুচ্ছের শেষ চাবিটিও কিন্তু তালা খুলতে পারে। ’
তবে এবার কোনো চাবি দিয়ে কারাগারের তালা খুলে বের হয়ে আসতে পারেন কি না পাপিয়া সেটিই এখন দেখার বিষয়।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুই সহযোগীসহ পাপিয়া ও তার স্বামীকে বিমান বন্দর থেকে আটক করে র্যাব। তারা দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন।
আটকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব জানায়, বৈধ আয় অনুযায়ী, পাপিয়ার বাৎসরিক আয় মাত্র ১৯ লাখ টাকা। অথচ শুধু গত তিন মাসেই তিনি একটি অভিজাত হোটেলে বিল পরিশোধ করেছেন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তিনি নারী সংক্রান্ত অপকর্ম ছাড়াও অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।
রাজধানীর গুলশানের ওই অভিজাত হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে সব সময় বুক করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাপিয়া। তিনি হোটেলটির বারে প্রতিদিন বিল পরিশোধ করতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।
তার বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, মদসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকাও উদ্ধার করেছে র্যাব।
জানা গেছে, তিনি পেট্রোবাংলার এক অবসরপ্রাপ্ত গাড়ি চালকের মেয়ে। আর স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন গানের শিক্ষক মতিউর রহমান চৌধুরীর বড় ছেলে। মতিউর রহমান স্থানীয় নজরুল একাডেমির অধ্যক্ষ।
এক সময় তাদের তেমন কিছুই ছিল না। গত পাঁচ বছরে বিপুল অর্থবিত্ত হাতিয়ে রাতারাতি বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট সবই করেছেন। দেশে গাড়ির ব্যবসার পাশাপাশি বিদেশেও খুলেছেন মদের দোকান।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
এসএইচএস/এজে