অথচ এই বস্তিতেই হাজার প্রাণের বসবাস। যে মানুষগুলো প্রতিনিয়ত নিজেরা স্বপ্ন সাজান, স্বপ্নের মতোই ছোট ছোট ঘরগুলোতে।
প্রতিবারই এই আগুন ঘিরে প্রশ্ন ওঠে বস্তির অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে। পুড়ে ছাই হওয়ার পর কর্তৃপক্ষও কারণ খুঁজে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। আদতে এই সমস্যা সমাধানের সময় কোথায়? কারণ সমাজের সবচেয়ে নিম্নবিত্ত ছিন্নমূলদের আবাস এই বস্তি।
বুধবার (১১ মার্চ) রাজধানীর রূপনগর এলাকার 'বারেকের বস্তিতে' অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পাঁচ শতাধিক ঘর। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিটের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। ততোক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখায় জনাকীর্ণ বস্তি পুরোটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রূপনগর এলাকায় একটি নিচু ঝিলের মধ্যে বিশাল এলাকাজুড়ে বস্তি। স্থানীয়রা বস্তির দুটি অংশকে বারেকের বস্তি ও মাতুব্বরের বস্তি হিসেবে জানেন। আগুনে বারেকের বস্তির প্রায় পুরোটা এবং মাতুব্বরের বস্তির বেশিরভাগ অংশই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া পুরো এলাকাজুড়েই শুধু পোড়া টিনের স্তূপ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে বস্তির মাঝামাঝি একটি ঘর থেকেই আগুনের সূত্রপাত। এরপর নিমিশেই এলাকাজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা স্বল্প সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করলেও আগুনের ছড়িয়ে পড়া আটকে রাখা যায়নি।
প্রায় ২৩ বছর ধরে এই বস্তিতে বসবাস করে আসছেন তোফায়েল। স্ত্রী, তিন ছেলে- এক মেয়ে ও এক ছেলের স্ত্রীসহ সাতজনের পরিবার নিয়ে বস্তির দুটি ঘরে বসবাস করে আসছিলেন। প্রতি ঘর ২৫০০ টাকা হিসেবে ভাড়া পরিশোধ করে আসছিলেন তিনি।
তোফায়েল জানান, বস্তির মাঝামাঝি একটি ঘরে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর কোনোরকম ঘরের টিভি আর ফ্রিজটা নিয়ে বের হতে পারলেও আর কিছুই আনতে পারেননি। ২৩ বছরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারের সবকিছুই হারিয়েছেন চোখের সামনেই। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই পুরো বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আগুন লাগার পর যেই হুড়াহুড়ি শুরু হইছে, একবার বাইর হইয়া আবার ভেতরে যাওয়ার মতোন পরিস্থিতি আছিলো না। প্রথমবার যা নিয়া বাইর হইছি তাই। এরপর দূরে খাড়ায়া নিজের চোখে সব পুইড়া যাইতে দেখছি।
বস্তির মালিকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা সরকারি জায়গা। যে ঘর উঠাইতে পারছে হেয়ই মালিক। যে ঘর উঠাইছে হেয়ই ভাড়াটিয়া উঠায়া ভাড়া নেয়। বস্তিতে গ্যাস-কারেন্টের লাইন ছিলো, বস্তিতে সবই থাকে। অনেকে সিলিন্ডারের গ্যাসও ব্যবহার করতো।
দুই মেয়ে ও স্ত্রীসহ বস্তির একটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন রেজাউল করিম। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গার্মেন্টসে চাকরি করেন। আগুন লাগার সময় তারা দুইজন কর্মস্থলে ছিলেন আর দুই মেয়ে স্কুলে ছিল।
তিনি বলেন, ফোনে আগুনের খবর পাইয়া দৌড়ায়া আইসা দেখি আগুন ছড়ায়া গেছে। কোনোরকমে খালি টিভি আর একটা ফ্যান বাইর করতে পারছি। আর কিছুই বাইর করতে পারি নাই।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে এসে বস্তিবাসীর তোপের মুখে পড়েন ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মী। তারা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ তোলেন।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস ও মেইনটেনেনস) লে. ক. জিল্লুর রহমান বলেন, ভুক্তভোগীরা সব হারিয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। পরে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা কাজ চালিয়ে গেছি।
বৈদ্যুতিক শট সার্কিট থেকে আগুনের উৎপত্তি হতে পারে, এমন ধারনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান জানতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, বস্তিজুড়ে ছড়ানো ছিটানো গ্যাস-বিদ্যুতের লাইন। যে কোন কারণে আগুন লাগলেও অবৈধ এসব গ্যাস লাইনের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এছড়া, প্রত্যেকটা ঘর একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো, পানির সংকট থাকায় আগুন নেভাতেও বেগ পেতে হয়েছে।
এদিকে, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লা ঘটনাস্থলে ভুক্তভোগীদের সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেন, বস্তিতে নেতাদের ২০টি- ৪০টি করে ঘর আছে। এই নেতাদের লিস্ট করা হবে।
আরও পড়ুন>> রূপনগরে বস্তিতে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ২৫ ইউনিট
বাংলাদেশ সময়: ২১৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০২০
পিএম/এজে