গাজীপুর: পানি দূষিত থাকুক অথবা বিশুদ্ধ, আজ বিশ্ব পানি দিবস। আমরা জানি পানির অপর নাম জীবন।
আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে শিল্প কারখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আর এসব শিল্প-কারখানার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি নির্গত হচ্ছে নদ-নদী ও খাল-বিলে। এতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে এসব নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি। ফলে এসব নদ-নদী ও খাল-বিল মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী শূন্য হয়ে পড়েছে। এতে করে দেশীয় প্রজাতির মাছ এখন আর হাট-বাজারে তেমন পাওয়া যায় না।
এক সময় গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলে শোল, বোয়াল, টেংরা, পুঁটি, কই, শিং, পাবদা, বাতাসি, কাজলি, ফলি, চাপিলা, রুই, কাতল, চিতল, বাইম, আইড় মাছ ও চিংড়িসহ প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। আর জেলেরা এসব মাছ ধরে হাট-বাজারে বিক্রি করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমানে শিল্প-কারখানার দূষিত তরল বিষাক্ত বর্জ্যে নদ-নদী, নালা, খাল ও বিলের পানি দূষিত হয়ে পড়ায় বিলুপ্তির পথে এখন এসব দেশীয় প্রজাতির মাছ। হাট-বাজারে এখন আর আগের মতো দেশীয় মাছ পাওয়া যায় না। অল্প কিছু পাওয়া গেলেও যার দাম অনেক বেশি। শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে প্রাণহীন হয়ে পড়েছে গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিল।
নদ-নদীর পাড়ের বাসিন্দারা বাংলানিউজকে জানান, এক সময় মানুষ তুরাগ নদে গোসল করতো, কাপড় ধোয়া, থালা-বাসন মাজা ও গৃহস্থালির বিভিন্ন কাজ করতো। সেচ কাজেও ব্যবহার করা হতো এ নদের পানি। বর্ষার ৪ মাস গাজীপুরের প্রায় সব নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি ব্যবহারের উপযোগী থাকে। তবে শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন বিষাক্ত তরল বর্জ্যের কারণে বছরের প্রায় ৮ মাস বিপজ্জনক থাকে এসব নদ-নদী ও খাল বিলের পানি। যা ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য।
শুধু শিল্প কারখানার দূষিত তরল বর্জ্যেই নয়, কৃষি কাজে ব্যবহৃত হওয়া মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক সেচের পানির সঙ্গে ধুয়ে নদীতে পড়ছে। হাট-বাজার, শহর ও বস্তি এলাকার গৃহস্থ বর্জ্য ফেলার সবচেয়ে বড় ভাগাড়ও এখন নদ-নদী ও খাল-বিল। নদ-নদীগুলোর তীরে গড়ে ওঠছে বেশির ভাগ শিল্পকারখানা। ওইসব কারখানার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করে নদ-নদী ও খাল-বিলে ফেলছে। অনেক কল কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন মেশিন থাকলেও তার বেশির ভাগই চালানো হচ্ছে না। এমন অভিযোগ করে দ্রুত এসব নদ নদী ও খাল বিলের পানি দূষণ মুক্ত করার জোর দাবি জানান এলাকাবাসী।
তুরাগ পাড়ের বাসিন্দা আমেনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, আগে এলাকার সবাই তুরাগ নদে গোসল করতো। এ নদের পানি দিয়ে কাপড় ধোয়া, থালা বাসন মাজা ও গৃহস্থালির সকল কাজ করতাম। তুরাগ নদসহ আশপাশের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কল-কারখানার দূষিত পানিতে রঙিন হয়ে গেছে। যা দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত। এখন ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য। এসব পানিতে এখন বিস্তার করছে মশা-মাছি ও বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মজলিশপুর এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা বাংলানিউজকে বলেন, এক সময় তুরাগ নদসহ আশপাশের নদ নদী ও খাল বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন আর এসব নদ-নদী ও খাল-বিলে পানি নেই, আছে শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য। যার ফলে বর্ষার শেষে এসব নদ-নদী ও খাল বিলের পানি কমতে শুরু করলেই মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মরে ভেসে ওঠে। বর্ষার ৩/৪ মাস এসব নদ নদীর পানি ব্যবহার করা যায়। কয়েক বছর ধরে বর্ষার পরপরই তুরাগ নদসহ আশপাশের নদ-নদী ও খাল-বিলের পানিতে কল কারখানার দূষিত রঙিন পানি মিশে বিষাক্ত করে ফেলেছে। যার ফলে এখন আর তুরাগ নদসহ গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কোনো কাজেই ব্যবহার করা যায় না। তুরাগসহ এসব নদ-নদী এখন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে।
মজলিশপুর জেলে পাড়া এলাকার সজল চন্দ্র বর্মন বাংলানিউজকে জানান, আমার বাপ-দাদারা আগে তুরাগ নদসহ বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিল থেকে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্ভার করতেন। আমার পেশাও ছিল মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করা। মাছ বিক্রির টাকায় সংসার চলতো। বর্তমানে তুরাগ নদসহ গাজীপুরের বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কল কারখানার তরল বর্জ্যে দূষিত হয়ে গেছে। যার ফলে এখন মাছ পাওয়া যায় না। এ কারণে পেশা বদলাতে হয়েছে। এখন খামারে চাষ করা মাছ আড়ত থেকে কিনে এনে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাই। আমার মতো শত শত জেলেরা এখন মাছ ধরা বাদ দিয়ে অন্যান্য পেশা বেছে নিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান ইউসুফ খান বাংলানিউজকে বলেন, ভয়াবহ দূষণের শিকার গাজীপুরের চারপাশের নদ-নদী ও খাল-বিল অভ্যন্তরের সকল প্রকৃতিক জলাশয়ের প্রতিবেশ আজ বিপন্ন। দূষণমুক্ত জলাশয় এবং পানি ব্যবহার উপযোগী করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
গাজীপুর সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার জান্নাতুন শাহীন বাংলানিউজকে বলেন, গাজীপুরের প্রায় সব উন্মোক্ত জলাশয়ের পানি দূষিত। শিল্পকারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত তরল বর্জ্য উন্মুক্ত জলাশয়ে মিশছে। এতে করে এসব জলাশয়ে মাছ কিংবা জলজপ্রাণি নেই। বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়লে ৩/৪ মাস অল্প প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, পানি কমে গেলে অতিমাত্রায় দূষিত পানিতে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী টিকে থাকতে পারে না। ফলে উন্মুক্ত জলাশয়ে এখন আর মাছের প্রজনন হয় না। ২০ বছর আগে গাজীপুরের বিভিন্ন জলাশয়ে অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। নদ-নদীর পানি দূষণমুক্ত, ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ বন্ধ ও ড্রেজিং করে নাব্যতা রক্ষার মাধ্যমে পানি দূষণমুক্ত করে মাছের অভয়াশ্রম করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
গাজীপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বিলকিস আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, নিরাপদ পানি নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জেলায় গভীর নলকূপ, সাবমার্সিবল পাম্প ও জলাধার নির্মাণের কাজ চলছে। নিরাপদ পানি নিশ্চিতে প্রতিবন্ধকতা দূর করার চেষ্টা করছে সরকার।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২১
আরএস/এমএইচএম